স্মৃতিবিজড়িত দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দির

0
1669

খবর৭১,উজ্জ্বল রায়:নড়াইল থেকে, স্মৃতিবিজড়িত দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দির কলকাতা সময় বিকাল ৪টা। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। মা আর বোনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি। আমরা বাংলাদেশ থেকে কলকাতা পৌঁছি। খারাপ আবহাওয়ার জন্য ৪ ঘণ্টা দেরি করায় পৌঁছতে রাত হয়। আগে থেকে চিন্তা ছিল, বিকাল ৫টার ভেতর কলকাতা পৌঁছে দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি দিয়ে আমাদের ভ্রমণ শুরু করব।

কিন্তু বাংলাদেশের বৃষ্টি যে আমাদের সঙ্গে কলকাতায় এসে হাজির হবে, তা ভাবতে পারিনি। যা-ই হোক, বাসা থেকে বের হয়ে ট্যাক্সি নিয়ে চললাম বিটি রোড ধরে। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। আমাদের ঢাকার মতোই যানজট, তবে আশপাশের সব ভবন বেশ পুরনো। বলে রাখা ভালো দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি সনাতন ধর্মালম্বীদের তীর্থস্থান। কলকাতার অদূরে হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত একটি কালীমন্দির। এটি উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার কামারহাটি শহরের অন্তঃপাতী দক্ষিণেশ্বরে অবস্থিত। ১৮৫৫ সালে প্রসিদ্ধ জমিদার রানী রাসমণি এ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট যোগী রামকৃষ্ণ পরমহংস এই মন্দিরে কালীসাধনা করতেন। কথিত আছে, রানী রাসমণি দেবী কালীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দির প্রতিষ্ঠাকালে রামকৃষ্ণ পরমহংসের দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় রানীকে প্রভূত সাহায্য করেছিলেন। রামকুমারই ছিলেন মন্দিরের প্রথম প্রধান পুরোহিত। ১৮৫৭-৫৮ সালে কিশোর রামকৃষ্ণ পরমহংস এই মন্দিরের পূজার ভার গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি এই মন্দিরকেই তার সাধনক্ষেত্ররূপে বেছে নেন। দেখতে দেখতে আমরা ডানলপ মোড়ে এসে পৌঁছলাম। সেখান থেকে ডান দিকে যাওয়া শুরু করল আমাদের গাড়ি। কিছু দূর যাওয়ার পর আমাদের গাড়ি থামিয়ে দেয় পুলিশ। সোজা আর যাওয়া যাবে না কারণ রাস্তায় কাজ চলছে। অগত্যা আমাদের উল্টো পথে হাঁটা শুরু করতে হলো গাড়ি রেখে। কিছু দূর যাওয়ার পর আবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হলো। নামার পর বাঁ দিকে হলো বেলুরমঠ যাওয়ার ঘাট আর ডান দিকে দক্ষিণেশ্বরের ভেতরে যাওয়ার রাস্তা। বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখলাম খুব সুন্দর একটি সেতু। এর নাম বালি ব্রিজ। সামনে থেকে দেখছিলাম বালি ব্রিজের অসাধারণ দৃশ্য আর গঙ্গার বয়ে চলা। কালক্ষেপণ না করে একের পর এক ছবি তুলতে লাগলাম। এদিকে আমার বোন বলল, শনিবার, মন্দিরে ভিড় হবে। আমরা চললাম মন্দির পানে। রাস্তার দুই ধারে দোকান বিভিন্ন ধরনের দ্রব্যাদি নিয়ে বসেছে। এসে পৌঁছলাম দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির প্রবেশদ্বারে, বাইরে থেকেই দেখা যায় ভেতরের অসাধারণ কারুকার্যময় মন্দিরের দৃশ্য। ২০ বছর আগে এত গুচ্ছের খাবারের দোকান, বেলন চাকি পাথরের শিবলিঙ্গ, লোকনাথ বাবা রুদ্রাক্ষের মালা পুঁতি দিয়ে তৈরি নানা রকম মালা, প্লাস্টিকের এরোপ্লেন, নকল জবা ফুলের মালা ইত্যাদির এত দোকান ছিল না। খাবার ও তখন আমরা টিফিন ক্যারিয়ারে করে নিয়ে যেতাম। আর হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়লেই শতরঞ্জি বিছিয়ে খাবার খেতে বসতাম। গঙ্গার দিক থেকে মনটা ভরিয়ে দিত শীতল হাওয়া। দক্ষিণেশ্বরের কথা বললে বোধহয় আমার ফুরাবে না। সেই সব কচুরির দোকান। আমরা বরাবর মন্দিরে পুজো দিয়ে এসে দুই নম্বর দোকানটায় কচুরি খেতাম। আজো তাই খাই। যদিও কোনো যোগ্যতার কারণে দ্বিতীয় দোকানটি প্রথম দোকানের চেয়ে বেশি ভালো, তা জানি না। ঘাটে গিয়ে গঙ্গার জলে হাত ডুবিয়ে চোখে-মুখে জল দিয়ে সেখানেই থাকা ডালার দোকান থেকে পুজোর ডালা নিয়ে আসা ছিল অভ্যাস। জুতা খুলে সেই যে মন্দির চত্বর পরিভ্রমণে বের হই, ফেরার পরে যথেষ্ট পুণ্য এবং ধুলোমাটিতে মাখা পা নিয়ে তবেই ফিরি, এর আগে নয়। বোন রোশনির সেই ছোটবেলার স্মৃতির রোমন্থন শুনতে শুনতে আমরা মন্দিরে এসে ঢুকলাম। জুতা আর ক্যামেরা নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা যায় না, তাই রোশনি বলল, ‘মাসি আর তুই গঙ্গার ঘাটে গিয়ে হাত-পা ধুয়ে পূজার ডালা নিয়ে ভেতরে গিয়ে ঘুরে আয়।’ আমি আর মা পূজার ডালা নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। মন্দিরে প্রবেশের মুখে বেশ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুরুষ-মহিলা আলাদা লাইন দিয়ে ঢুকতে হয়। ভেতরে প্রবেশের পর অন্য রকম এক পরিবেশ, একদিকে কীর্তন চলছে, অন্যদিকে দেবীর মুখ দর্শনের আর পূজা দেয়ার জন্য বিশাল লাইন। আমি আর মা লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মন্দির চত্বর বৃষ্টির জন্য ভেজা কিন্তু ভক্তের অভাব নেই। কালীবাড়ি চত্বরে কালীমন্দির ছাড়াও একাধিক দেবদেবীর মন্দির অবস্থিত। মূল মন্দিরটি নবরতœ মন্দির। এটি টালিগঞ্জের রামনাথ মণ্ডল নির্মিত নবরতœ মন্দিরের আদর্শে বুঝি নির্মিত। আমরা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে মায়ের মুখ দর্শন করে বারোটি আটচালা শিবমন্দির দর্শন করতে গেলাম। শিবমন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নদী, অসাধারণ পরিবেশ। অন্য পাশে মন্দিরের উত্তরে রয়েছে রাধাকৃষ্ণ মন্দির এবং মন্দিরের দক্ষিণে নাটমন্দির অবস্থিত। মন্দির চত্বরের উত্তর-পশ্চিম কোণে রামকৃষ্ণ পরমহংসের বাসগৃহ। মূল মন্দির চত্বরের বাইরে রামকৃষ্ণ পরমহংস ও তার পরিবারবর্গের স্মৃতিবিজড়িত আরো কয়েকটি স্থান রয়েছে। আমরা পুরো মন্দির ঘুরে দেখলাম। এ এক অন্য রকম অনুভূতি। জাগতিক সব চিন্তার বাইরে ছিলাম তখন। দেখতে দেখতে আমাদের বিদায়ের কাল ঘনিয়ে এল, মন্দির থেকে বাইরে বের হয়ে সেই বিখ্যাত কচুরি খেয়ে ফিরে চললাম আমাদের গন্তব্যে। যেতে হলে: কলকাতার যেকোনো প্রান্ত থেকে ট্যাক্সি নিয়ে যাওয়া খুব সহজ। তাছাড়া বাসে যেতে চাইলেও যেতে পারবেন। বাসে যেতে হলে ডব্লিউবিএসটিসি বাসে করে বেলে হাঁটা পর্যন্ত আসতে হবে। সেখান থেকে দক্ষিণেশ্বর।
খবর৭১/জি:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here