চৌগাছার আবেদ আলী জীবন যুদ্ধে হার না মানা এক সৈনিক

0
2286

মুকুরুল ইসলাম মিন্টু চৌগাছা (যশোর) ॥ জীবন যুদ্ধে হার না মানা এক ব্যাক্তির নাম আবেদ আলী (৮০)। যে বয়সে তার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন, নাতি নাতনী নিয়ে হৈহুল্লোল করে সময় পার করার কথা, সেই বয়সে তিনি নিরালস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। পেট ভরে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার তাগিদেই তার এই পরিশ্রম বলে তিনি জানান। সমাজের কোন বৃত্তবান যদি বৃদ্ধ আবেদ আলীর পাশে দাঁড়ায় তাহলে জীবনের বাকি সময়টুকু তিনি একটু শান্তিতে পার করতে পারবেন বলে মনে করছেন অনেকে।
সূত্র জানায়, উপজেলার পাতিবিলা ইউনিয়নের পুড়াহুদা গ্রামের মৃত নঈমুদ্দিনের ছেলে বৃদ্ধ আবেদ আলী (৮০)। দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে তার বেড়ে উঠা। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার বয়স ৩০ বছরের মত। দেশ মাতৃকার টানে তিনি দেশ ত্যাগ করেননি। নিজ এলাকায় অবস্থান করে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতা করে গেছেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে, আমরা পেয়েছি লাল সবুজের পতাকা, অনেকে হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু কোন যোগাযোগ না করায় অক্ষরজ্ঞান আবেদ আলী পাইনি সেই সুযোগটুকু আবেগ জড়িত কন্ঠে বললেন বৃদ্ধ আবেদ আলী। তারপর কেটে গেছে অনেকটি বছর। পরিবার পরিজন নিয়ে তিনি নিরালস ভাবে কাজ করে গেছেন। ছয় কন্যা সন্তানকে বড় করেছেন তাদেরকে বিয়ে দিয়েছেন। এখন স্ত্রী গোলাপী বেগমকে (৭০) নিয়ে জীবনের বাকি সময়টুকু একটু ভাল ভাবে বেঁচে থাকার আপ্রান চেষ্টা। আবেদ আলী বয়সের ভারে এখন আর সেভাবে কাজ করতে পারেননা। তাই এই বয়সে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে চৌগাছা বাজারে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের বাড়ি থেকে দুপুরের খাবার নিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠানে পৌছে দেয়া। একটি ভাঙ্গাচোরা সাইকেলের পিছনে ও সামনে টিফিন বাটি ঝুলিয়ে সাইকেল ঠেলে ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তিনি পৌছান চৌগাছা বাজারে। এরপর টিফিন বাটি চিনে চিনে প্রতিটি দোকানে পৌছে দিয়ে তার দায়িত্ব শেষ। এর ফলে তিনি সপ্তাহে দোকান প্রতি রোজগার করেন ৪০ টাকা। এই টাকা দিয়ে তার সংসার চলে। শনিবার খাবার নিয়ে চৌগাছায় আসার পথে থানা সংলগ্নে কথা হয় আবেদ আলীর সাথে। তিনি জানান, বেঁচে থাকার তাগিদে এই পরিশ্রম তার। কোন ছেলে সন্তান নেই বৃদ্ধ আবেদ আলীর। ৬ মেয়ে সকলের বিয়ে হয়ে গেছে। পরিবার তারা স্বামী স্ত্রী দুইজন। জমি জায়গা বলতে ভিটে বাড়ির ১০ শতক জমি আছে তার। শত কষ্টেও সে ভিটের জমিটুকু বিক্রি করেননি। এই জমিতে চৌগাছার শিল্পপতি রায়হান উদ্দিন একটি বাড়ি নির্মান করে দিয়েছেন। এখন আর বড় কোন কাজ সে করতে পারেনা। তাই পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে ব্যবসায়ীদের খাবার বাড়ি থেকে নিয়ে দোকানে পৌছে দেয়া। তিনি জানান, সপ্তাহে ৬ দিন তিনি এই কাজ করেন। এরজন্য প্রতি হাটে (শুক্র ও সোমবার) দোকানীরা তাকে ২০ টাকা করে ৪০ টাকা দেয়, এতেই তার সংসার চলে। তিনি বলেন, পুড়াহুদা, সাদিপুর ও ইয়াপুর গ্রাম থেকে ১২ থেকে ১৫টি ব্যবসায়ীর খাবার নিয়ে তিনি বাজারে পৌছান। প্রতি দিন সকাল ১১ টার সময় তিনি নিজ বাড়ি পুড়াহুদা থেকে বের হন। এরপর তিনটি গ্রামের ওই সব বাড়িতে বাড়িতে যান তিনি। প্রতিটি ব্যবসায়ীর পরিবার খাবার রান্না করে প্রস্তুত করে রাখেন। আবেদ আলী বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে ১ টার দিকে রওনা হয় চৌগাছার উদ্যেশ্যে। ভাঙ্গা সাইকেলের সামনে পিছনে টিফিন বাটির প্যাকেট ঝুলিয়ে কখনও সাইকেল চালিয়ে আবার কখনও ঠেলে তিনি পৌছান গন্তব্যে। ব্যবসায়ীদের দোকানে দোকানে খাবার পৌছে দিয়ে ওই দিনের ডিউটি শেষ তার। শীত, গ্রীস্ম বর্ষা কোন কিছুই আবেদ আলীর পথ চলাকে থামাতে পারেনি। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে তিনি এই পেশায় নিয়োজিত আছেন। আবেদ আলী বলেন, খাবার বহন করে যা রোজগার হয় আর বয়স্ক ভাতার টাকায় চলে আমার সংসর। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত এভাবেই কাজ করে যেতে চান আবেদ আলী। কোন সহৃদয় ব্যাক্তি বৃদ্ধ আবেদ আলীর পাশে দাড়ালে তিনি বাকি জীবন একটু শান্তিতে পার করতে পারেন বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here