খবর ৭১: ট্রেন এসে কাজান স্টেশনে দাঁড়ালে প্রতিটি কামরার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন তরুণী স্বেচ্ছাসেবিকা। স্রেফ একটি কথা বলার জন্য। ‘ওয়েলকাম টু কাজান’। সেই সকাল থেকে বিদেশিদের আসা শুরু হয়েছে তো হয়েছেই! উঁকি মারছে ব্রাজিলের পতাকা। মস্কোয় যেমন রেড স্কোয়ার সংলগ্ন নিকোলস্কায়া স্ট্রিট প্রাণে টইটুম্বুর, বিদেশিরা নামলেই সেখানে ছোটে, কাজানে তেমন বাউমান স্ট্রিট। ট্রেন থেকে নেমেই ব্রাজিলিয়ানরা ওখানে ছুটছেন।
বেলজিয়ানরাও। সেখানে জুটছে অভ্যর্থনা। কাজান স্টেশনে বাঙালিদেরও চোখে পড়ল অনেক। কী অদ্ভুত, ব্রাজিলিয়ান-বাঙালি-বেলজিয়ান মিলেমিশে এক এই তাতারস্তানের রাজধানীতে।
সাধারণ মানুষের জন্যই যদি এমন আন্তরিকতা, তা হলে নেইমার এবং কেভিন দে ব্রুইনিদের জন্য কেমন অভ্যর্থনা থাকবে? সবুজ হলুদ বেলুন উড়িয়ে নেইমারের জন্য বহু ভক্ত অপেক্ষা করছিলেন বিমানবন্দরে। কাজান শহরটা বিখ্যাত ভোলগা নদীর ধারে, আর একটা ‘ইস্তানবুল’। তুরস্কের মতো কাজানেও এশিয়া এবং ইউরোপের সাংস্কৃতিক মিলন দেখলাম পথে পথে। একবার পাশের চার্চ বা মসজিদ দেখলে মনে হয়, এশিয়ায় এসে গিয়েছি। পরক্ষণেই দেখি ইউরোপের মতো পরিবেশ। ভোলগা নদীটা একটু দূরে। শহরের ভিতরে ঢুকেছে রেকা কাজাঙ্কা নদী। তার ধারেই স্টেডিয়াম, যা দেখলে লন্ডনের ওয়েম্বলি এবং এমিরেটস স্টেডিয়ামকে মনে পড়বে। তিনটি স্টেডিয়ামই এক সংস্থার তৈরি। ভোলগা নয়, কাজানের স্টেডিয়াম হল কাজাঙ্কা নদীর ধারে শহরের নতুন অংশে। নদীর মাঝে ছোট ছোট দ্বীপ। তাতে অসংখ্য বক। সেখানে ঢোকার মুখে একটা প্রশ্নই তাড়া করে সারাক্ষণ। কী ছায়াঘেরা রহস্যময়তা আছে এখানে, যেখানে রোনালেদা, মেসি, ক্রুস পরপর ঘায়েল হয়ে থামেন শেষে? তিতে নিশ্চয়ই এ প্রশ্ন মাথায় নিয়ে মাঠে নামবেন আজ। প্রেস মিটে আসার আগেই তিনি স্টপার মিরান্দাকে নিয়ে ঘুরে এলেন মাঠটা। এখানে তিনি র্প্যাক্টিস করতে পারেননি। গেলেন তাসায়াক স্ট্রিটে রুবিন কাজান ক্লাবের মাঠে। বিশ্বকাপ শুরুর আগে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিভাবানদের টিম বলা হচ্ছিল জার্মানি, ¯েপন, ব্রাজিল, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এবং বেলজিয়ামকে। প্রথম দুটো দেশ চলে যাওয়ার পরে, তিনটে টিম পড়ে গিয়েছে একটা দিকে। বেলজিয়ামের হ্যাজার্ড, দে ব্রুইনি, লুকাকু-প্রতিভাবান ত্রিভুজকে আটকাতে এই ম্যাচে তিতে কী ভূমিকা নেন, সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করছি। তিতের সবচেয়ে বড় সমস্যা, ডিফেন্সের সামনে কাসেমিরো নামক এক পাথরের দুর্গ নেই। ব্রাজিল সাংবাদিকরা বলছেন, মার্সেলো ফিরতে পারেন কাজানে। তাতে কি ডিফেন্স সমস্যা মিটবে? তিতে আবার এক ডিফেন্ডারকে অধিনায়ক করে নামছেন। গ্রুপ লিগের একটা ম্যাচের মতো-মিরান্দা। যে টিমে নেইমার-কুতিনহো-জেসুসের মতো তীক্ষè ফরোয়ার্ড, সেখানে দিনের পর দিন কেন ডিফেন্ডার অধিনায়ক? প্রশ্ন জাগছিল বারবার। সেটা কিছুটা উত্তর পাওয়া গেল উরুগুয়ের তারকা দিয়েগো লুগানোর কথায়। লুগানো যা বলছেন, তাতে ডিফেন্সই এই ব্রাজিলের সেরা শক্তি। প্রাক্তন উরুগুয়ে অধিনায়ক লুগানোর মন্তব্য, ‘থিয়াগো সিলভা হল ডিফেন্ডারদের পেলে। টেকনিক্যালি এবং ট্যাকটিক্যালি ওর সময়জ্ঞান অসাধারণ।’ তার পরের কথাটাও সমান আকর্ষক, ‘ব্রাজিলে বিশ্বের সেরা ডিফেন্ডাররা খেলে। স্টপার পজিশনে থিয়াগো, মিরান্দা, মারকুইনোস, পেদ্রো। শেষ কবে এত ভালো স্টপার এসেছে টিমে? দিয়েগো গোদিন, সের্খেই রামোসের সঙ্গে বিশ্বের সেরা স্টপার থিয়াগো সিলভা।’ এখানেই পরিসংখ্যানটা ভালো মানাবে। তিতে পঁচিশ ম্যাচে গোল হজম করেছেন মাত্র ছটি। কাজানে নেইমারের ‘জান’ বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে স্টপারে সিলভা-মিরান্দা জুটি, মিডফিল্ডে পাউলিনহো-ফের্নান্দিনহো জুটি। ফিলিপে লুইস শেষ দুটি ম্যাচে লেফটব্যাকে খেলার সময় ডিফেন্সকে ভরসা দিতেন। মার্সেলোর থেকে তাঁর ডিফেন্স করার গুণ ভালো। ফিট হয়ে এ বার ফিরছেন মার্সেলো। যে কারণে বেলজিয়াম ক্যাপ্টেন ভিনসেন্ট কো¤পানি মস্কো থেকে কাজান আসার আগে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ব্রাজিলের সেরা স¤পদ হল তাদের ব্যালেন্স। তারা অ্যাটাক এবং ডিফেন্স, দুটো সমান ভাবে করতে পারে।’ ব্রাজিল দারুণ বলার পাশেও কো¤পানি একশো শতাংশ নিশ্চিত জেতার ব্যাপারে। বলে রেখেছেন, এই জয় তাঁদের প্রজন্মকে স্মরণীয় করে দেবে।
রাশিয়ার অধিকাংশ কিশোর-কিশোরী এখনও আলেকজান্দার পুশকিনের বিখ্যাত কবিতার বুয়ান দ্বীপের কথা জানে। রহস্যময় একটা দ্বীপ। সে রকমই একটা রহস্যময় দ্বীপ আছে কাজান শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে, ভোলগা নদীর ওপর। জার ইভান দ্য গ্রেট ষোলোশো শতাব্দীতে এই এসভিয়াস্ক দ্বীপে একটা দুর্গ বানিয়েছিলেন। এখন সেখানে ৩০০ জন অধিবাসী, ৩৭ খানা অসাধারণ দ্রষ্টব্য। সোভিয়েত জমানায় সব চার্চকে করে দেওয়া হয়েছিল বন্দিশালা এবং পাগলাগারদ। এখন সব স্বাভাবিক। কাজান শহরে আর একটা ক্রেমলিনও পাবেন মস্কোর মতো। ছোট, কিন্তু বর্ণময় দুর্গ। এমন ক্রেমলিন রাশিয়ার অনেক শহরে আছে।বেলজিয়াম টিমটাকে মনে হয় ও রকমই রহস্যময়। ওরকমই হিসেবের বাইরে। বর্ণময়ও। ইউরো কাপের সময় তাদের ওপর অত প্রত্যাশা ছিল, অথচ বেলজিয়াম সীমান্ত থেকে সামান্য দূরেই হেরে অস্থির। ইউরোপে অনেক সোনালি প্রজন্মকে শূন্য হাতে ফিরতে দেখেছি। বেকহ্যাম- জেরার- ল্যা¤পার্ড-আওয়েনদের ইংল্যান্ড, ফিগো-কোস্তা-নুনো গোমস-দেকোদের পর্তুগাল। বেলজিয়াম টিমটাকেও বলা হয় সে দেশের সোনালি প্রজন্ম। ব্রাজিলিয়ানদের তুলনায় বেলজিয়ানদেরও কাপ জেতার দায় কম নয়। আপনারা কি ওপেন গেম খেলবেন? ভিনসেন্ট কো¤পানি প্রশ্নটা শুনে কিছু না বলেও অনেক কিছু বলে দিয়েছেন। ‘এই প্রশ্নটা নিয়ে আমি কিছু বলব না। তবে আমরা গোল করতে চাই। কিন্তু বেশি আক্রমণে গিয়ে সুইসাইড করব না।’
সোজা কথা, ভোলগা নদীর তীরে, কাজান ক্রেমলিনের ধারে বেলজিয়ানরাও ব্যালেন্স ফুটবলের ¯ে¬াগান তুলছেন। এ দিনই ¯েপনের কাগজে খবর বেরিয়েছে, বেলজিয়াম কোচ রবের্তো মার্তিনেস বিশ্বকাপের পর ¯েপনের কোচ হতে পারেন। মার্তিনেসের পরীক্ষা হল, কী ভাবে কাসেমিরোর অভাবকে অস্ত্র করে তুলবেন। রিয়াল মাদ্রিদে বারবার দেখেছি, যতই বিবিসি বা ক্রুস-মদ্রিচ খেলুন না কেন, কাসেমিরো খেলতে না-পারলে রিয়াল বিপদে পড়ে যাচ্ছে। জিদান সেটা বন্ধ করতে পারেননি। কাসেমিরোর বিকল্প ফের্নান্দিনহোকে দিয়ে তিতে সেটা বন্ধ করতে পারলে বুঝব তাঁর মস্তিষ্কের অঙ্ক কেমন একশোয় একশো। ম্যাঞ্চেস্টার সিটির চার বন্ধু দে ব্রুইনি এবং ফের্নান্দিনহো। কো¤পানি এবং জেসুস। চেলসির উইলিয়ান এবং হ্যাজার্ড। ছয় সতীর্থর ওপরে অনেক কিছু নির্ভর করছে ম্যাচটায়। এঁর বাইরে আছেন নেইমার এবং লুকাকু। লুকাকু কত ভয়ঙ্কর? প্রশ্ন করলে মিরান্দা সটান বলে দিলেন, ‘একা লুকাকু নয়, বেলজিয়ান টিমে সবাই ভালো। সবাইকে নিয়ে ভাবতে হবে।’ ক্রিস্তিয়ানো রোনালেদা ‘যব ছোড় চলি লখনউ নগরি’ স্টাইলে জুভেন্তাসে গেলে বিশ্ব ফুটবলের মানচিত্রই পাল্টে যেতে চলেছে আজ কালের মধ্যে। প্রায় দুয়োরানির পর্যায়ে চলে যাওয়া সিরি এ তে আবার তখন ‘জাগিয়া উঠেছে প্রাণ, ওরে উথলি উঠেছে বারি’। বেলজিয়াম-ব্রাজিল ম্যাচে ব্রাজিল জিতলে বিষণè বিশ্বকাপেও সেই ছবি দেখব। কাজানে যত রাশিয়ানদের সঙ্গে কথা হচ্ছে, তাঁদের অধিকাংশেরই পছন্দ ব্রাজিল। ইংরেজ, ক্রোট, সুইডিশ-উল্টোদিকে যাঁরা আছেন, তাঁরাও সবাই চান, ফাইনালটা ব্রাজিল খেলুক তাদের সঙ্গে। ছোটবেলা থেকে যে ম্যাচটা দেখছেন স্বপ্নে।
ব্রাজিলিয়রা কী স্বপ্ন দেখছেন, বলে দিতে হবে? কাজানে শান্তির প্রতীক হিসেবে সর্বধর্ম সমন্বয়ের এক বিশাল স্তম্ভ তৈরি চলছে ১৯৯২ থেকে। তার সামনে ব্রাজিলিয়ানরা নেইমারকে নিয়ে তৈরি একেবারে টাটকা গান ধরেছেন, ‘জোগার পারা আনিমার’। এ তো অবধারিত, গানটা শেষ হচ্ছে নেইমারের নামে একাধিক জয়ধ্বনি দিয়ে। নেইমারই স্বপ্নের ফেরিওয়ালা।
সূত্র: এইসময়
খবর ৭১/ই: