মুকুরুল ইসলাম মিন্টু, চৌগাছা (যশোর) প্রতিনিধি:যশোরের চৌগাছার শারীরিক প্রতিবন্ধী মেধাবী ছাত্র ওয়াকিমুল ইসলাম রিফাত তার কর্মে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা সকলেরই মনে রাখার মত। প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়ে সে এখন চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্র। পড়ালেখার পাশাপাশি নিজের হাতে তৈরী করেছেন নানা ধরনের সামগ্রী। অবসরে বাড়ির অঙিনায় করা ছোট্ট একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসে করছেন বেচাকেনা। হুইল চেয়ারই যার চলাফেরার একমাত্র অবলম্বন সেই মেধাবী মুখ সৃষ্টি করছে অভাবনীয় সব কর্মযজ্ঞ। তার নিজ হাতে তৈরী করা নানা ধরনের জিনিস পত্র দেখতে প্রতিদিনই বাড়িতে সাধারণ মানুষ ভিড় করছেন। স্থানীয়রা মনে করছেন সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে রিফাত একদিন দেশের সম্পদে পরিনত হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
সূত্র জানায়, চৌগাছা পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ডের কলেজপাড়ার দরিদ্র পরিবারে জন্ম মেধাবী মুখ শারীরিক প্রতিবন্ধী ওয়াকিমুল ইসলাম রিফাত (১৪)। পিতা আবুল খায়ের পেশায় একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আর মা লকি বেগম গৃহিনী। শিল্পপতি রায়হান উদ্দিনের দানের বাড়িতে তাদের বসবাস। ওয়াকিমুল ইসলাম রিফাত জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। জন্মের পর হতে নানা কষ্ট আর যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে সে বেড়ে উঠেছে। খুব ছোট বেলা থেকেইে রিফাত ছিল বেশ মেধাবী। হাটা চলা ফেরা করতে পারেনা রিফাত। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে সৃষ্টি জগত নিয়ে নানা ভাবনা চিন্তা করেই দিন পার করছে। এভাবে কেটে গেছে প্রায় ১৪ বছর। ওয়াকিমুল ইসলাম রিফাতের মা লাকি বেগম জানান, তার তিন সন্তান। দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে সাব্বির হোসেন অনার্সের ছাত্র, মেঝে ছেলে প্রতিবন্ধী রিফাত স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেনীর ছাত্র আর একমাত্র মেয়ে আরশি সুলতানা একই বিদ্যালয়ে রিফাতের সাথে ৪র্থ শ্রেনীতে পড়ালেখা করে। তিনি জানান, রিফাত জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধি। কিন্তু সে বরাবরই বেশ মেধাবী। স্কুলে ভর্তি করার পর সে প্রতি ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করে । বর্তমানে সে ৪র্থ শ্রেনীতে পড়ে, এই ক্লাসেও তার রোল নং ১। তার শরীরের যে গঠন তাতে করে একা একা চলতে পারেনা। হুইল চেয়ারে বসিয়ে দেয়ার পর একজন সেটি ঠেলে তারপর গন্তব্যে পৌছে দেয়। এ কারনে দুই ভাই বোনকে একই স্কুলে ভর্তি করেছি। বোন আরশি সুলতানা সকালে হুইল চেয়ারে করে ভাই রিফাতকে স্কুলে নিয়ে যায় আর ছুটির পর একই ভাবে বাড়িতে নিয়ে আসে। ছোট্ট রিফাত এখন চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্র। সে অনেক কিছুই শিখেছে যা আমরা কখনও কল্পনাও করেনি জানান গর্ভধারিনী মা লকি বেগম। তিনি বলেন, রিফাত স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে দিন পার করে। দুপুরে খাওয়া শেষে পড়তে শুরু করে। তার পড়ার জন্য একটি বিশেষ ব্যবস্থা করে রেখেছি, যাতে তার কষ্ট কিছুটা কম হয়। স্কুলের পড়া শেষ করে সে কখনও বসে আবার কখনও শুয়ে কাগজ কলম দিয়ে কিছু একটা তৈরী করে আবার ভেঙ্গে ফেলে। গত ২ বছর ধরে সে অন্তত ২০টির মত নানা ধরনের জিনিসপত্র তৈরী করেছে। এরমধ্যে রয়েছে পরিবহন, জিপগাড়ি, মাইক্রোবাস, এ্যাম্বুলেন্স, রেফরিজারেটর, টর্সলাইট, ফ্যান, দ্বিতল ভবনসহ অনেক কিছু। রিফাত এই সব সামগ্রী তৈরীতে ব্যবহার করেছে বাতিল বলপেন, মোটা কাগজ ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী। তার নির্মিত এ্যাম্বুলেন্স হর্ন বাজিয়ে ছুটে চলছে। পুলিশের জীপ গাড়ি চলছে আপন গতীতে। রেফরিজারেটরে রাখা হয় কোমল পানীয়। এ সব নির্মান দেখে সকলে হতবাক হয়েছেন। একজন শারীরিক প্রতিবন্ধীর পক্ষে এ সব কিভাবে সম্ভব বলছেন অনেকে। নির্মাতা প্রতিবন্ধী রিফাত জানান, তার নির্মান কাজে সে কখনও কারও সহযোগীতা গ্রহন করেনি। পড়ালেখার সাথে সাথে যখন মনে হয়েছে তখনই আমি কিছু একটি তৈরী করতে বসে গেছি। স্বাভাবিক চলাফেরা করতে না পারার করানে আমার একটি লাইট বা ঘর বাড়ি তৈরী করতে একের অধিক দিন সময় লেগেছে। বর্তমানে আমার ইচ্ছা একটি মটরবাইক তৈরী করা। এরজন্য ২০ হাজার টাকার প্রয়োজন। এই টাকা পেলে আমি বাইক তৈরী করে তা সত্যি সত্যিই রাস্তায় চালিয়ে বেড়াব। রিফাতের স্কুলের শিক্ষক ও সহপাঠিরা জানায়, সে অত্যান্ত মেধাবী ছাত্র। ক্লাসে উপস্থিত হওয়ার পর পড়ালেখা ছাড়া সে কিছুই করেনা। প্রতিবন্ধী হওয়ার কারনে সকলেই তাকে আদর করে। স্থানীয়রা জানান, রিফাত অবশ্যই মেধাবীদের মধ্যে একজন। কেননা সে প্রতিবন্ধী হয়ে যা তৈরী করছে তা সকলকে ভাবিয়ে তুলেছে। এখন প্রয়োজন সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা, তাহলে একদিন রিফাত পিতা মাতাসহ দেশবাসীর মুখ উজ্জল করবে।