খবর৭১: বাংলাদেশে মার্চ থেকে মে-জুন পর্যন্ত এই কমাস বজ্রপাতের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। আর এই সময়ে প্রতিবছরই বজ্রপাতে দেশে তিন থেকে চারশো লোকের প্রাণহানি হয়। বিশ্বে বজ্রপাতে যে পরিমাণ মানুষের মৃত্যু হয় তার এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশে। কিন্তু কেন এতো বজ্রপাত? কারণ কী? মোটা দাগে বলতে গেলে, শীত-বসন্তের দীর্ঘ শুষ্ক সময় শেষে আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়া ও উঁচু বৃক্ষের পরিমাণ কমে যাওয়াই অতিরিক্ত বজ্রপাতের কারণ। বিশেষ করে বায়ুমন্ডলে বাতাসের তাপমাত্রা ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগের তুলনায় কম থাকে বিধায় গরম বায়ু দ্রুত উপরে উঠে ততই আর্দ্র বায়ুর সংস্পর্শ পায়। তখন গরম বায়ু দ্রুত ঠান্ডা হওয়ায় বজ্রমেঘের সৃষ্টিতেই বজ্রপাত সংঘটিত হয়।
বাংলাদেশে প্রতিবছরই বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে। এরইমধ্যে সরকার সারা দেশে ১০ লাখ তালগাছ রোপন করে বজ্রপাত মোকাবিলার পরিকল্পনা করছে।
বিজ্ঞানীদের মতে, আকাশে যে মেঘ তৈরি হয়, তার ২৫ থেকে ৭৫ হাজার ফুটের মধ্যে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে বেশি। বজ্রপাতের গতি প্রতি সেকেন্ডে ৬০ হাজার মিটার বেগে নিচে নেমে যায়। সেই বিদ্যুতের জন্যই আমরা আকাশে তাৎক্ষণিক আলো জ্বলতে দেখি। তখন সেটার দূরত্বের ওপর নির্ভর করে শব্দটা তখন আমাদের কানে চলে আসে।
কাছে হলে শব্দ আগে এবং দূরে হলে শব্দ অপেক্ষাকৃত বেশি সময় পরে শোনা যায়। যখন তখন বৃষ্টি তার সঙ্গে বজ্রপাত। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো এটিও একটি নিয়ন্ত্রণহীন দুর্যোগ। কাজেই এ থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পাওয়া হয়তো কখনোই সম্ভব নয়। তারপরও কিছু বৈজ্ঞানিক সতর্কতামূলক পন্থা রয়েছে। যেগুলো অনুসরণ করলে কিছুটা হলেও বজ্রপাত এড়িয়ে মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব।
আন্তর্জাতিক আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বজ্রপাতের পেছনে বায়ুদূষণ অন্যতম কারণ। বজ্রপাতকে আবহাওয়া সম্পর্কিত দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন কেউ কেউ।
বাংলাদেশে বছরের দুটি মৌসুমে বজ্রপাত বেশি হয়। জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। আবহাওয়া অধিদফতরের সাপ্তাহিক ও দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস তালিকায় শেষ যুক্ত হয়েছে বজ্রঝড়।
তবে এই ভয়াবহ বজ্রপাত থেকে নিজেদের নিরাপদে রাখতে অবশ্যই কিছু সতর্কতামূলক দিকনির্দেশনা মাথায় রাখতে হবে। বজ্রঝড় চলাকালে আপনার করণীয় সম্পর্কে তেমনই কিছু টিপস দেয়া হলো।
১. ঘন ঘন বজ্রপাত হতে থাকলে কোনো অবস্থাতেই খোলা বা উঁচু স্থানে থাকা যাবে না। সবচেয়ে ভালো হয় কোনো একটি পাকা দালানের নিচে আশ্রয় নিতে পারলে।
২. কোথাও বজ্রপাত হলে উঁচু গাছপালা বা বিদ্যুতের খুঁটিতে বজ্রপাতের আশংকা বেশি থাকে। তাই এসব স্থানে আশ্রয় নেবেন না। খোলা স্থানে বিচ্ছিন্ন একটি যাত্রী ছাউনি, তালগাছ বা বড় গাছ ইত্যাদিতে বজ্রপাত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি থাকে।
৩. বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি থাকবেন না। জানালা বন্ধ রাখুন এবং ঘরের ভেতর থাকুন।
৪. বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করবেন না। এমনকি ল্যান্ড লাইন টেলিফোনও স্পর্শ করবেন না। বজ্রপাতের সময় এগুলো স্পর্শ করেও বহু মানুষ আহত হয়।
৫. বজ্রপাতের সময় বৈদ্যুতিক সংযোগযুক্ত সব যন্ত্রপাতি স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন। টিভি, ফ্রিজ ইত্যাদি বন্ধ করা থাকলেও ধরবেন না। বজ্রপাতের আভাস পেলে আগেই এগুলোর প্লাগ খুলে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করুন।
৬ বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতরে থাকলে সম্ভব হলে গাড়িটি নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিন। গাড়ির ভেতরের ধাতব বস্তু স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন। গাড়ির কাচেও হাত দেবেন না।
৭. এমন কোনো স্থানে যাবেন না, যে স্থানে আপনিই উঁচু। বজ্রপাতের সময় ধানক্ষেত বা বড় মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে যান। বাড়ির ছাদ কিংবা উঁচু কোনো স্থানে থাকলে দ্রুত সেখান থেকে নেমে যান।
৮. বজ্রপাতের সময় আপনি যদি ছোট কোনো পুকুরে সাঁতার কাটেন বা জলাবদ্ধ স্থানে থাকেন তাহলে সেখান থেকে সরে পড়ুন। পানি খুব ভালো বিদ্যুৎ পরিবাহী।
৯. কয়েকজন মিলে খোলা কোনো স্থানে থাকাকালীন যদি বজ্রপাত শুরু হয় তাহলে প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে সরে যান।
১০. যদি বজ্রপাত হওয়ার উপক্রম হয় তাহলে কানে আঙুল দিয়ে নিচু হয়ে বসুন। চোখ বন্ধ রাখুন। কিন্তু মাটিয়ে শুয়ে পড়বেন না। মাটিতে শুয়ে পড়লে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।
১১. আপনার উপরে বা আশপাশে বজ্রপাত হওয়ার আগের মুহূর্তে কয়েকটি লক্ষণে তা বোঝা যেতে পারে। যেমন বিদ্যুতের প্রভাবে আপনার চুল খাঁড়া হয়ে যাবে, ত্বক শিরশির করবে বা বিদ্যুৎ অনুভূত হবে। এ সময় আশপাশের ধাতব পদার্থ কাঁপতে পারে। অনেকেই এ পরিস্থিতিতে ‘ক্রি ক্রি’ শব্দ পাওয়ার কথা জানান।
১২. বজ্রপাতের সময় চামড়ার ভেজা জুতা বা খালি পায়ে থাকা খুবই বিপজ্জনক। এ সময় বিদ্যুৎ অপরিবাহী রাবারের জুতা সবচেয়ে নিরাপদ।
১৩. আপনার বাড়িকে বজ্রপাত থেকে নিরাপদ রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন। এজন্য আর্থিং সংযুক্ত রড বাড়িতে স্থাপন করতে হবে। ভুলভাবে স্থাপিত রড বজ্রপাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে।
১৪. প্রত্যেকের বাড়িঘর বৈজ্ঞানিক উপায়ে বজ্রপাত প্রতিরোধী হিসেবে তৈরি করা। দু-ভাবে বাড়িঘরকে বজ্রপাত প্রতিরোধী করা যেতে পারে। ক. বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বিশেষ করে ইস্ত্রি, ফ্রিজ, টিভি, কম্পিউটার, এসি, মোবাইল সেট, ওভেনসহ ঘরের বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে সুরক্ষাকরণের জন্য ইলেকট্রিকেল আর্থিং করা খ. সুউচ্চ গগনচুম্বী দালানকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার জন্য পুরো দালানকে আর্থিং করা।
১৫. নৌকার মধ্যে থাকলে এর লম্বা ছই বা মাস্তুল থেকে দূরে গিয়ে শুয়ে পড়তে হবে।
উল্লেখ্য, বিশ্বের উন্নত দেশসমূহে বছরে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার প্রতি কোটিতে ৪ জনের কম। বিশ্বে প্রতিবছর বজ্রপাতে প্রায় ২ হাজার থেকে ২৪ হাজার লোক মারা যায় এবং প্রায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার লোক আহত হয়। পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১০০ বার বজ্রপাত হয় অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ৮০ লক্ষবার বজ্রপাত হয়। বজ্রপাতে বিশ্বে ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশে ২০১৭ সালে ২০৫ জন, ২০১৬ সালে ২৪৫ জন, ২০১৫ সালে ১৮৬, ২০১৪ সালে ২১০, ২০১৩ সালে ২৮৫, ২০১২ সালে ৩০১, ২০১১ সালে ১৭৯ জন বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন।
খবর৭১/এস: