খবর৭১:ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়ায় এখন তাঁকে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা আরো কঠিন হবে বলে জানিয়েছে কূটনৈতিক সূত্রগুলো। তাদের মতে, নিজ দেশে ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে এবং সন্তুষ্ট হয়েই সাধারণত এ ধরনের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন মঞ্জুর করা হয়।
সেই হিসেবে ব্যক্তি তারেক রহমানের বাংলাদেশে ঝুঁকির বিষয়টি আমলে নিয়েই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে। এমন ক্ষেত্রে সাজাপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন মামলার আসামি হিসেবে তাঁকে ফেরত পাওয়া অত্যন্ত কঠিন।
প্রায় একই মত পোষণ করে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব সমশের মবিন চৌধুরী গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া অবশ্যই বড় ধরনের একটি বিষয়। যাঁরা রাজনৈতিক আশ্রয় চান তাঁরা বিশেষ কোনো কারণ দেখিয়ে সেটা চান। সেই কারণ যদি এমন হয়, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়—যেকোনো মূল্যে তাঁকে দেশে আনা হবে, তাহলে তাঁর রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার বিষয়টি আরো পোক্ত হয়ে যায়। তিনি আরো শক্তভাবে বলতে পারবেন, আমাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে এবং রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়াটা আমার জন্য যথার্থ।
সমশের মবিন চৌধুরী বলেন, শুধু তারেক রহমান নয়, যেকোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রেই এমনটি হয়।
ঢাকায় বেশ কয়েকজন কূটনীতিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরাও তারেক রহমানের পাসপোর্ট ও নাগরিকত্ব সমর্পণ করা না করা নিয়ে বড় দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক বিতর্ক নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তাঁদের মতে, এখানে স্পষ্টত দুটি বিষয়।
একটি, তারেক রহমানের বাংলাদেশি পাসপোর্ট জমাদান এবং অপরটি, পাসপোর্ট জমা দেওয়ার মাধ্যমে নাগরিকত্ব প্রত্যাহার। তারেক রহমানের পাসপোর্ট ব্রিটিশ হোম অফিসের (স্বরাষ্ট্র দপ্তর) পক্ষ থেকে বাংলাদেশ হাইকমিশনে পাঠানোর বিষয়ে চিঠিটিও বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পশ্চিমা কূটনীতিক কালের কণ্ঠকে বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো ব্যক্তির তথ্যের গোপনীয়তার বিষয়ে বেশ সচেতন। ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তাবিষয়ক ব্রিটিশ আইন এখনো ব্যক্তি তারেক রহমানের যুক্তরাজ্যে ‘লিগ্যাল স্ট্যাটাস’ (আইনি অবস্থান) প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা। কিন্তু পাল্টাপাল্টি চ্যালেঞ্জের মুখে এক পক্ষ তারেক রহমানের পাসপোর্টের অনুলিপি, তথ্য ও চিঠি সাংবাদিকদের হাতে তুলে দিয়েছে। আরেক পক্ষ চিঠি নিয়ে প্রশ্ন তুললেও স্বীকার করে নিয়েছে যে তারেক রহমান ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন।
ওই কূটনীতিক মনে করেন, রাজনৈতিক বিতর্ক ও পাল্টাপাল্টি চ্যালেঞ্জের মধ্যে দুই পক্ষই ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার ক্ষুণ্ণ করেছে। চিঠির ব্যাখ্যা ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তরই দিতে পারে। ওই ব্যাখ্যা দেওয়ার অর্থ হবে তা স্বীকার বা অস্বীকার করা। দুটির কোনোটিই হয়তো তারা করবে না।
অপর এক কূটনীতিক বলেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হয়তো তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্যে বলতে চেয়েছিলেন যে নাগরিক হিসেবে বিদেশে বাংলাদেশির যে পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট তারেক রহমানের ছিল, তা-ও তিনি জমা দিয়েছেন। পাসপোর্ট জমা দিয়ে নাগরিকত্ব সমর্পণ করেছেন—পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এমন যুক্তির আইনি ব্যাখ্যা ভিন্ন হলেও তাঁর বক্তব্যেই বিএনপিকে তারেক রহমানের রাজনৈতিক আশ্রয়ের বিষয়টি প্রথমবারের মতো স্বীকার করে নিতে বাধ্য করেছে।
এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব সমশের মবিন চৌধুরী বলেন, এটি ঠিক যে বিএনপি প্রথমবারের মতো স্বীকার করল যে তারেক রহমান রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু বিএনপি কি কখনো বলেছে যে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় নেননি? আগে কি অস্বীকার করেছে কোনো সময়?
সমশের মবিন চৌধুরী বলেন, তারেক রহমান যে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করেননি, সেটি এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে যে চিঠিটি দেওয়া হয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, সেটিতে একাধিক ভুল রয়েছে। সেই চিঠি নিয়েও অনেকের মধ্যে অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে—চিঠিটি আদৌ আসল কি না? ওরা আসলেই পাঠিয়েছে কি না? এ ধরনের ভুল ব্রিটিশ সরকারের আমলাতন্ত্রের মধ্যে সাধারণত হয়ে থাকে না। তারাই সারা বিশ্বকে চিঠিপত্র লেখা শিখিয়েছে। তিনি আরো বলেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিসের ভিত্তিতে, কোন রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি করলেন এর ব্যাখ্যা তিনিই ভালো দিতে পারবেন। আইন বিশেষজ্ঞরা এরই মধ্যে পরিষ্কারভাবে বলেছেন, বিদেশে রাজনৈতিকভাবে কেউ আশ্রয় নেওয়ার অর্থ এই নয় যে তিনি তাঁর নাগরিকত্ব হারিয়েছেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ এবং নাগরিকত্ব সমর্পণ—দুটি আইনগত দিক দিয়ে ভিন্ন বিষয়। কোনো ব্যক্তি যত দিন বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকে তত দিন নিজ দেশের নাগরিক সুবিধা পায় না। তাদের পাসপোর্টও দেওয়া হয় না। সেই হিসেবে বিদেশের মাটিতে তাঁর মূল নাগরিকত্ব অনেকাংশেই অর্থহীন।
রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়ায় ব্যক্তি তারেক রহমানের ওপর এর প্রভাব জানতে চাইলে সাবেক এই পররাষ্ট্রসচিব বলেন, রাজনৈতিক আশ্রয় নিলে তিনি দেশে আসতে পারবেন না। বিদেশে অর্থাৎ তিনি যে দেশে আছেন ওই দেশের আইন, বিধি-বিধান মেনে চললে সেখানে থাকতে তাঁর কোনো অসুবিধা হবে না।
তারেকের রাজনৈতিক আশ্রয়ের কারণে তাঁর দলের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব বিষয়ে ২০১৫ সালে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করা সমশের মবিন চৌধুরী বলেন, এর রাজনৈতিক প্রভাব তেমন কিছু হবে না। রাজনৈতিক আশ্রয়ের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। রাজনৈতিক প্রভাব কী পড়বে সেটি অন্যান্য কারণের ওপরও নির্ভর করবে। শুধু রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার ওপর এটি নির্ভরশীল নয়।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী গত সপ্তাহে লন্ডন সফরকালে তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এরই মধ্যে দুটি মামলায় তারেকের সাজা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ বেশ কয়েকটি মামলা বিচারাধীন। গত মাসে লন্ডনে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে তারেক রহমানের মতো ফেরারি আসামিদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে পারস্পরিক আইনি ও আসামি প্রত্যর্পণ বিষয়ক সহযোগিতার ব্যাপারে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের আসামি প্রত্যর্পণ চুক্তি না থাকায় এ বিষয়ে একটি চুক্তি সইয়ের সক্রিয় চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজনীতি ছাড়ার শর্তে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে যান তারেক রহমান। এরপর ২০১২ সালে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা জানিয়ে যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আদালতে আবেদন করলে এক বছরের মধ্যে সেটি মঞ্জুর হয়।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাজ্যে সাধারণত প্রথম দফায় পাঁচ বছরের জন্য রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হয়। তবে পরিস্থিতি বিবেচনা করে সেটির মেয়াদ বাড়ানো হলে বা অন্য ক্যাটাগরিতে সেখানে থাকার সুযোগ রয়েছে।
খবর৭১/জি: