নতুন ভোটার আওয়ামী লীগের মাথা ব্যথার কারণ হবে: ইকোনমিস্ট

0
303

খবর ৭১: শনিবার ব্রিটেনের দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৮ সালের যথাযথ নির্বাচনের পর তরুণ নতুন ভোটার হয়েছেন ২ কোটি ৩০ লাখ। তাঁরা নিশ্চিতভাবেই শাসক দল আওয়ামী লীগরে অন্যতম মাথাব্যথার কারণ হবে। ইকোনমিস্টের এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বলা হয়, গত ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন শুরু হয়। শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন সংসদে। কিন্তু এর পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হল থেকে রাতের অন্ধকারে ছাত্রীদের বের করে দেওয়া এবং কোটা সংস্কারের আন্দোলনে তিনজনকে তুলে নেওয়া নিয়েও উদ্বেগ আছে আন্দোলনকারীদের মাঝে।

প্রতিবেদনে অরাজনৈতিক ইস্যুর আন্দোলনে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নিয়ে আন্দোলন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ওই নির্বাচনে বিএনপি অবস্থান কী হবে, তাও তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্যতম বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের সরকারি চাকরিতে কোটা থাকার বিষয়টি দিয়ে। বিজেপি-শাসিত দেশটিতে বিশেষ কিছু বর্ণের মানুষের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা আছে।

ইকোনমিস্ট দাবি করেছে, লাখ লাখ মানুষের রক্তে স্বাধীনতার অর্জন করা বাংলাদেশের বিভেদরেখা হলো ইতিহাস। বর্তমান শাসক দল আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা লড়াই করেছিলেন, তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মদের জন্য সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটা রেখেছিল দলটি। অন্যান্য আরও কিছু গোষ্ঠীর জন্য রয়েছে ২৬ শতাংশ কোটা। এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে কোটাপদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। তাদের দাবি হলো, সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হতে হবে শতকরা ৯০ শতাংশ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা আন্দোলন ও অবস্থান কর্মসূচির কারণে শিক্ষার্থীদের ওই দাবি মেনে নেন। ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগে সভানেত্রী বলেন, সব কোটা বাতিল। তবে এখন পর্যন্ত (২২ এপ্রিল) সরকারিভাবে কোটা বাতিলের আনুষ্ঠানিক কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নেই। এ পর্যায়ে কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারীরা পাল্টা বিক্ষোভের পরিকল্পনা করছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আপাতত স্থগিত থাকা কোটা সংস্কারের আন্দোলন প্রথমে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে ৮ এপ্রিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসসহ দেশের কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও তা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে। ওই দিন রাতেই রাজধানী ঢাকায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের শাহবাগ এলাকা থেকে সরিয়ে দিতে পুলিশ চেষ্টা করে। পরে কাঁদানে গ্যাস, লাঠি ও জলকামান ব্যবহার করে। শিক্ষার্থীরাও পাল্টা কিছু আক্রমণ চালান। আহত হন বহু শিক্ষার্থী। পুলিশের এ প্রতিক্রিয়া এবং আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের উপস্থিতি আন্দোলনকে আরও জোরদার করে।

ষাটের দশকের তুখোড় ছাত্রনেত্রী ও বর্তমান সরকারের কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর সংসদে দেওয়া বক্তব্য ফুসে ওঠেন আন্দোলনকারীরা। তারা প্রতিবাদ জানান। কোটা সংস্কারের সমর্থনে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে শিক্ষার্থীরা সরকারের কয়েকটি ওয়েবসাইট হ্যাক করে কোটা সংস্কারের বার্তাও ছড়িয়ে দেন।

তবে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের মাঝে ৮ এপ্রিল মাঝরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে ব্যাপক ভাঙচুরের কথা দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়নি। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন আন্দোলনকারীরা। সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান বলেন, ছাত্রদের বিরুদ্ধে করা মামলা সরকার যদি প্রত্যাহার না করে, তবে আন্দোলন আবার শুরু হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের এমবিএর ছাত্র রাশেদ খান দাবি করেন, কিছুদিন আগে তাকেসহ আন্দোলনের তিন নেতাকে সাদাপোশাকে পুলিশ জোর করে গাড়িতে ওঠায়। এরপর তাদের হাতকড়া পরিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে। পরে কোনো অভিযোগ দায়ের না করেই তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। রাশেদ খানের অভিযোগ, ‘দেশে সব রাজনৈতিক আন্দোলন নিষিদ্ধ। যেকোনো মুহূর্তে আমরা অপহরণের শিকার হতে পারি।’

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে অনেকবার ‘কোটা আন্দোলন’ হয়েছে উল্লেখ করে ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি চাকরিতে ৪৪ শতাংশ শিক্ষার্থী মেধার ভিত্তিতে চাকরি পেয়ে থাকেন। অনেক শিক্ষার্থী নারীদের ১০ শতাংশ, ধর্মীয় এবং ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিকগোষ্ঠী ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ কোটার পক্ষে। কিন্তু তাঁরা ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশের পক্ষে নন। এখন পর্যন্ত আড়াই লাখ লোককে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ আছে, অনেকেই ঘুষের মাধ্যমে সার্টিফিকেট নিয়েছেন। কেউ কেউ আবার সার্টিফিকেট পেয়েছেন জালিয়াতির মাধ্যমে।

বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসগুলো এখন আপাতত শান্তই আছে। তবে এ বিরুদ্ধবাদিতা (কোটা সংস্কার আন্দোলন) আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতি বড় সমালোচনা হিসেবেই দেখা হচ্ছে বলে ইকোনমিস্ট মনে করে। আন্দোলনে প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীদের বেশি তৎপরতা চোখে পড়েছে। একটি প্ল্যাকার্ডে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাবা ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে টেনে এনে লেখা হয়েছে, ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে, বৈষম্য সহ্য করা হবে না।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুুর রহমান ইকোনমিস্টের প্রতিবেদককে বলেছেন, কর্মসংস্থান সংকটের কারণে এ আন্দোলন জোরদার হয়েছে। জন্মহার কমে এলেও বাংলাদেশের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের বয়স ৩৫-এর নিচে। সরকার বছরে ২০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সুযোগ তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু যে হারে কর্মসংস্থান হচ্ছে, তার চেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে শ্রমশক্তি। তরুণ বেকারদের সংখ্যা এখন ১০ শতাংশেরও বেশি।

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নয় বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি যখন নিচ্ছে, কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন এল সেই সময়। বাকি রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থা এখনো বিশৃঙ্খল। রাজনীতির মাঠে শেখ হাসিনার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এখন কারাগারে। সংসদের বাইরের প্রধান দল বিএনপি এখনো নিশ্চিত নয় যে তারা আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন কি না। বিএনপির মিত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।

এ অবস্থায় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা কি এমন একটি নির্বাচন পাব, যেটার ফলাফল আগাম অনুমান করতে পারব না?’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here