উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি:
শিবুপদ রায়ের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা শিবুপদ রায়ের বাবাকে হত্যা করেন। তখন শিবুপদের বয়স ১১ বছর ৮ মাস। পিতৃহীন সংসারে মা ও দুই বোনকে নিয়ে জীবনযুদ্ধে নেমে পড়েন তিনি। লঞ্চে করে নড়াইলের কালিয়া থেকে বড়দিয়া এবং খুলনার দৌলতপুর পর্যন্ত কলা বিক্রি করতেন শিবুপদ। ছোটকালিয়া এলাকার বাসিন্দা শিবুপদ জানান, লঞ্চে কলা বিক্রির সময় একদিন বিকেলে দেখা হয় নড়াইলের বড়দিয়ার ভুষিমাল ব্যবসায়ী নিত্যানন্দ সাহার সাথে। লঞ্চের ছাদে ব্যবসায়ী নিত্যানন্দের সাথে তার পরিচয়। ওনাকে (নিত্যানন্দ) কলা কেনার কথা বললেও, জানিয়ে দেন তিনি কলা কিনবেন না। শিবুপদ বলেন, এক পর্যায়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিত্যানন্দ জিজ্ঞাসা করেন-তুমি খেয়েছো? আমি বললাম, না। তখন বললেন-কলা খাও। কলা খেতে না চাইলেও শর্ত দিলেন, আমি খেলে তিনি কলা কিনবেন। তখন তিন থেকে চারটি কলা খেয়েছিলাম। নিত্যানন্দ পুরো তিন হালি কলার দাম দিয়েছিলেন। এ সময় প্রতিদিন কলা বিক্রি করে ১০ থেকে ১২ টাকা আয় করতাম। এ টাকা দিয়ে সংসার চালাতাম। আমার সংসারের সব কথা শুনে ব্যবসায়ী নিত্যানন্দ সাহা তার দোকানে থাকা-খাওয়াসহ প্রতিমাসে ৩০০ টাকা বেতনে কর্মচারীর কথা বলেন। ওইদিনই আমি তার (নিত্যানন্দ) সাথে বড়দিয়ায় গেলাম। এই দোকানে সাত বছর কাজ করেন শিবুপদ। দোকানে কর্মচারীর কাজ করেও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন তিনি। সবশেষ সাত হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পেয়েছেন। বেতনের টাকা জমিয়ে ১৯৭৮ সালে কালিয়া পৌর এলাকায় ভুষিমালের দোকান দেন শিবুপদ রায়। তখন পুঁজি ছিল ১৬ হাজার ৬০০। লঞ্চের কলা বিক্রেতা থেকে কোটি টাকার সবজি ও মৎস্যচাষি তিনি। গড়েছেন সমন্বিত কৃষি খামার। ২৬৭ একর জমিতে আবাদ করেছেন বিভিন্ন ধরণের সবজি। মাছ চাষের পাশাপাশি রয়েছে দিগন্ত জোড়া বোরো ধানের আবাদও। এ ধরণের কৃষি খামার অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে অন্যদেরও। জীবন সংগ্রামী এই কৃষক নড়াইলের কালিয়া উপজেলার শিবুপদ রায় (৫৮)। কালিয়া পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ভক্তডাঙ্গা বিলে গড়ে তুলেছেন বিশাল কৃষি খামার। সমন্বিত এ খামার থেকে বছরে উৎপাদন হয় ২ কোটি টাকার মাছ, সবজিসহ বিভিন্ন ধরণের কৃষিপণ্য। জীবনসংগ্রামের পথ ধরে ১৯৮৮ সালে ১০ একর জমি ইজারা (লিজ) নিয়ে বাড়ির পাশের চিংড়িমাছের চাষাবাদ করেন তিনি। তখন থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি শিবুপদ রায়ের। ঘেরের পাশাপাশি করেন ধানছাটাই কলও (রাইচমিল)। তবে, ২০১৫ সাল থেকে বড় আকারে সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে তোলেন শিবুপদ। প্রথমে ২২৬ একরে এবং পরবর্তীতে ২৬৭ একর জমিতে চাষাবাদ করে আসছেন সবজিসহ চিংড়ি ও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এর মধ্যে এ বছর ১০০ একর জমিতে বোরো ধানের চাষাবাদ করেছেন। ২৬৭ একর জমি ৫০০ জনের কাছ থেকে ইজারা নিয়েছেন শিবুপদ। ২০ বছর চুক্তিতে ইজারা নেয়া এসব জমির মালিকদের একরপ্রতি বছরে দিতে হয় সাড়ে ১২ হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকা। আর শিবুপদ রায়ের নিজের বলতে মাঠে ১০ একর এবং বসতবাড়িতে চার একর জমি আছে। এখানে উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিষ ও ফরমালিনমুক্ত বলে জানালেন শিবুপদ। সমন্বিত কৃষি খামারের উদ্যোক্তা শিবুপদ রায় নড়াইল জেলা অনলাইন মিডিয়া ক্লাবের সভাপতি উজ্জ্বল রায়কে জানান, আমার কৃষি খামারে টমেটো, কুমড়া, পেপে, করোলাসহ বিভিন্ন ধরণের শাক-সবজির আবাদ করা হচ্ছে। পাশাপাশি ২৬৭ একরের বিশাল ঘেরে চিংড়ি ও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষাবাদ করা হয়। এছাড়া আমন ও বোরো ধানের আবাদ করা হচ্ছে। এসব কৃষি পণ্য যশোর, গোপালগঞ্জ, মাগুরা নড়াইল, ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এখানে ২২ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন এবং খন্ডকালীন হিসাবে আছেন ১০০ থেকে ১৫০ শ্রমিক। এই কৃষি খামার থেকে বছরে প্রায় ২ কোটি টাকার কৃষিপণ্য ও মাছ বিক্রি করা হয়। শ্রমিক ও পণ্য পরিবহন খরচ এবং ইজারা নেয়া জমির মালিকদের টাকা পরিশোধের পর শিবুপদ রায়ের বছরে লাভ থাকে প্রায় ৫০ লাখ টাকা। ছোট কালিয়ার জয়নাল আবেদীন বলেন, কৃষিক্ষেত্রে শিবুপদ রায়ের অনেক অবদান। এ ধরণের খামার আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। খামারকর্মী কালিয়ার গোবিন্দনগরের অখিল রায় বলেন, এখানে সারাবছরই চাষাবাদ হয়। এখন দিগন্ত জোড়া বোরো ধান। আশা করছি এ বছর ধানের ভালো ফলন হবে। ঘেরপাড়ে টমেটো, কুমড়া ও পেঁপের আবাদ করা হয়েছে। ধানকাটা হলে শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ করা হবে। নড়াইল শহরের রূপগঞ্জ বাজারের কাঁচামাল ব্যবসায়ী মুনছুর মোড়ল জানান, শিবুপদ রায়ের খামারে উৎপাদিত টমেটো, পেঁপে, কুমড়াসহ শাক-সবজির ব্যাপক ক্রেতা চাহিদা রয়েছে। কালিয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রাজিব রায় জানান, এ ঘেরে গলদা চিংড়ি, রুই, কাতলা, গ্লাসকাপ, মিনারকাপ, তেলাপিয়া, পুঁটিসহ বিভিন্ন মাছের চাষ হয়। ভরা মওসুমে প্রতিদিন তিন থেকে চার মণ চিংড়িসহ অন্যান্য মাছ ১০ থেকে ২৫ মণ বিক্রি করা হয়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এ মাছ ঢাকাসহ আশেপাশের জেলার মৎস্য ব্যবসায়ীরা কিনে নেন। কালিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুবির কুমার বিশ^াস তিনি, নড়াইল জেলা অনলাইন মিডিয়া ক্লাবের সভাপতি উজ্জ্বল রায়কে জানান, শিবুপদ রায়ের খামারের শাক-সবজি বিষ ও ফরমালিনমুক্ত হওয়ায় স্থানীয় বাজারে চাহিদা বেশি। এখানে ভরা মওসুমে প্রতিদিন ৫০ মণ টমেটো তোলা হয়। এছাড়া প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ মণ পেঁপে ও এক হাজার পিস লাউ এবং প্রতি মওসুমে এক হাজার মণ মিষ্টি কুমড়া, দুই থেকে আড়াই হাজার মণ শশা ও করোলা বিক্রি করা হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নড়াইলের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ চিন্ময় রায় নড়াইল জেলা অনলাইন মিডিয়া ক্লাবের সভাপতি উজ্জ্বল রায়কে জানান, ২৬৭ একরের এ বহুমুখী ক্ষেতটি নয়নাভিরাম ও দৃষ্টিনন্দন। পাশাপাশি এটি অত্যন্ত লাভজনক। কৃষিক্ষেত্রে শিবুপদকে জীবন্ত কিংবদন্তি বলা যায়। এ ধরণের কৃষি খামার অন্যদেরও অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। এটি শুধু অনুকরণীয়ই নয়, আমাদের দেশে বিরল দৃষ্টান্ত। এদিকে, শিবুপদ রায় শুধু একজন সফল কৃষকই নন; কালিয়া পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। ১৯৯৯ সাল থেকে টানা তিনবার পৌর কাউন্সিলর তিনি। দুই ছেলে ও এক মেয়ে শিবুপদের। স্ত্রী কবিতা রায় গৃহিণী। বড় ছেলে শিমান রায় (২৬) এসএসসি পাশের পর পোল্ট্রি মুগরির খামার করেছেন। ছোট ছেলে শিমুল রায় কলেজে লেখাপড়ার পাশাপাশি বাবার খামার দেখাশোনা করেন। মেয়ে নূপুর পড়ালেখা করছে নবম শ্রেণিতে। মা, স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে নিয়ে শিবুপদ রায়ের সুখের সংসার।
খবর ৭১/ ই: