উজ্জ্বল অধিকারী, বেলকুচি (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধিঃ
সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে শব্দ দূষণ ক্রমশ দিন দিন বেড়েই চলছে । পরিবেশ ও জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ শব্দ দূষণ ভয়াবহ আকারের রূপ নিয়েছে। গত ১০ বছরের ব্যবধানে বেলকুচি শব্দ দূষণ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। নীরব আবাসিক এলাকা সমূহেই শব্দ দূষণ এরই মধ্যে ৭০ ডেসিবেলের ওপর পৌঁছেছে। শব্দের তীব্রতায় মানুষের নাক, কান ও গলায় নানা রকম জটিল উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। একই কারণে মানুষের আচরণে রুক্ষতা ও মেজাজের ভারসাম্যহীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। শব্দ দূষণ রোধে আইন থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্তৃপক্ষ আইনের প্রয়োগের ব্যাপারে উদাসীন। বেলকুচি আবাসিক এলাকায় ক্রমশ বেড়েই চলছে পাওয়ারলুম ইতিপূর্বে হস্তচালিত তাঁত থাকলেও বর্তমানে যন্ত্রতচালিত বা বিদ্যুৎ চালিত পাওয়ারলুম বেড়েই শব্দের মাত্রা নতুন করে যোগ হয়েছে। ইদানিং শব্দ দূষণের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে জেনারেটর। বিদ্যুৎ চলে গেলে একই সময়ে বিভিন্ন ধরনের জেনারেটর থেকে প্রচন্ড শব্দের উৎপন্ন হয়।
যা পথচারীদের প্রচন্ড বিরক্তির উদ্রেগ করে ও অনাকাংখিত শব্দ দূষণ করে। শব্দ দূষণ নগর জীবনের শান্তি ও নির্জনতা ক্রমশ কেড়ে নিচ্ছে। আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠেছে যন্ত্রচালিত পাওয়ারলুম ফলে নির্জনতা ভেঙ্গে তৈরি হচ্ছে কোলাহল। বাড়ছে শব্দের মাত্রা। অফিস আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, মসজিদ, রেষ্টুরেন্ট, ওয়ার্কশপ, কোন খানেই শব্দের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নেই। অথচ ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তর আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, নীরব এলাকা, শিল্প এলাকা, ফিল্ম টিভি, স্টুডিও, হলরুম, থিয়েটার, অফিস ও লাইব্রেরি দোকান ও বেকারি, রেষ্টুরেন্ট ও ওয়ার্কশপ প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন স্থানের জন্য দিবা রাত্রিতে নির্দিষ্ট ডেসিবেল শব্দ মাত্রা নির্ধারণ করা থাকলেও কেউ তা মানছে না। বেলকুচির তামাই শিল্প এলাকার চেয়ে বেশি মাত্রায় । আবাসিক এলাকাগুলো এখন শব্দ দূষণের শিকার। বিভিন্ন ওয়ার্কশপ শব্দ দূষণের অন্যতম ক্ষেত্র। বেলকুচিতে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে এসব ওয়ার্কশপ।
নিত্য দিনের কাজের টুংটাং শব্দে প্রকম্পিত হচ্ছে আশ-পাশ। এছাড়া হাসপাতাল, ক্লিনিক, মসজিদ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে ‘নীরবতা পালন করুন’ লেখা থাকলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী শব্দের স্বাভাবিক সহনীয় মাত্রা হচ্ছে ৪৫ ডেসিবেল। কিন্তু বেলকুচিতে বেশির ভাগ সময় শব্দের মাত্রা থাকছে ৯০ থেকে ১শ’ ডেসিবেল। এ অবস্থা এখন বেলকুচির অধিকাংশ এলাকায়। শব্দ দূষণ বেলকুচির জন্য এখন এক ভয়াবহ পরিবেশ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শব্দ দূষণের কারণে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্তি শব্দ দূষণ একটা শিশুকে বেড়ে উঠার পূর্বেই তাকে বধিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ বিষয়ে বেলকুচি উপজেলা নির্বাহী অফিসার ওলিউজ্জামান বলেন, আমরা পরিবেশ অধিদপ্তরের সাথে যোগাযোগ রাখছি, কিন্তু বিষয়টি সম্পুর্ন পরিবেশ অধিদপ্তরের। তারা এ বিষয়ে তদারকি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। ১৯৯৭ সালের পরিবেশ ও বন সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১শ’ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত নিরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এসব স্থানে মোটর গাড়ির হর্ন বাজানো এবং মাইকিং করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এসব এলাকায় শব্দের সহনীয় মাত্রা দিনে ৪৫ ডেসিবেল এবং রাতে ৩৫ ডেসিবেল থাকবে। কিন্তু বেলকুচিতে এই সমস্ত নিরব এলাকায় বর্তমান শব্দের মাত্রা সহনীয় মাত্রা অপেক্ষা ২২ থেকে ৩৮ ডেসিবেল বেশি। বর্তমানে নিরব এলাকা, শিল্প এলাকা সর্বত্রই শব্দ দূষণের মাত্রা ভয়াবহ।
বেলকুচিতে শব্দ দূষণের দুঃসহ পরিস্থিতি সম্পর্কে ও বেলকুচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাঃ সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মাত্রাতিরিক্ত শব্দ মানুষের মাথা ঝিম ঝিম, মাথা ব্যথা, কানে কমশোনা,এবং শিশুদের মানুষিক বিকাশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার সমস্যা দেখা দিতে পারে। ক্রমাগত শব্দ দূষণের ফলে কানের টিস্যুগুলো আস্তে আস্তে বিকল হয়ে পড়ে। বেলকুচিতে যত্রতত্র ভাবেই গড়ে উঠছে পাওয়ারলুম নিয়মনীতি না মেনেই শিল্প কারখানা করছে ফলে শব্দ দূষণ এখন ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে। এর শিকার হচ্ছে সকল স্তরের মানুষ। শব্দ দূষণ মানুষের স্নায়ুগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে। তখন সে আর স্বাভাবিক শব্দ কানে শুনতে পারে না। কানের মধ্যে সব সময় এক ধরনের অস্বাভাবিক শব্দ হতে থাকে। ডাক্তারি ভাষায় এটাকে ‘টিনিটাস’ বলে। কানের যন্ত্র নিয়েও সে ভালো শুনতে পারে না। শব্দ দূষণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে শিশুদের। হঠাৎ গাড়ির শব্দে তারা লাফিয়ে উঠছে এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের সাইকোলজিক্যাল সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
এতে করে শিশুর মানসিক বিকাশ বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। শব্দ দূষণের কারণে মনসংযোগের মারাত্মক বিগ্ন ঘটে। এ জন্য শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্রমাগত সব ধরনের উচ্চ শব্দই মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এর মধ্যে পাওয়ারলুমের শব্দ বেশি ক্ষতি করছে। মাত্রাতিরিক্ত শব্দ মৃত্যুঝুকি ও উচ্চ রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। শিশুরা খিঁচুনি রোগে আক্রান্ত হতে পারে এবং সারা জীবনের জন্য বধির হয়ে যেতে পারে। এছাড়া ক্রমেই ইন্দ্রিয়শক্তি লোপ পেয়ে শিশু মানসিক প্রতিবন্ধীও হয়ে যেতে পারে। নিরব এলাকাতেও অবলীলায় হর্ণ বাজাচ্ছে। উচ্চ স্বরে কথা বলা থেকে শুরু করে বৃহৎ শিল্প কারখানা সবই শব্দ দূষণের উৎস। বিশ্বের অনেক দেশে গাড়ির হর্ণ বাজানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই সব উন্নত দেশের শহর গুলোতে আরো বেশি যানবাহন থাকা সত্ত্বেও উচ্চ শব্দের কোন বিপদ নেই। বেলকুচি শহরকে শব্দ দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। শব্দের মাত্রাকে কিভাবে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে দ্রুত ব্যবস্থা নিলে হয়তো মুক্তি পাওয়া যাবে। নতুবা সময়ের ব্যবধানে বেলকুচিবাসী রাজধানী ঢাকার মতো শব্দ দূষণ নগরীতে পরিণত হবে।
খবর ৭১/ ই: