এম এ হামিদ, শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি:
পাহাড়ী ছড়া, চা বাগান, ঝুলন্ত সেতু, ফোয়ারা, বটবৃক্ষ, শহীদ মনোমেন্ট, ফুলবাগান, সবুজ ঘাসে আবৃত্ত খোলা মাঠ আর প্রিয়জনকে নিয়ে বসে গল্প করার জন্য ছাতার নিচে বেঞ্চ, সবকিছু মিলিয়ে অসাধারণ একটি জায়গায় রুপ নিয়েছে এটি। যা এক দিকে খোরাক জোগায় বিনোদনের অন্যদিকে এটি জাগ্রত করে দেশাত্ববোধও। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ‘বধ্যভূমি ৭১’ আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমিতে ২০১০ সালে স্মৃতিস্তম্ভ্য নির্মাণের পর থেকে দর্শনার্থীদের ভীড় উপচে পড়ছে। এছাড়াও প্রতিদিনই দর্শনার্থীরা আসেন বধ্যভূমি দেখতে। শ্রীমঙ্গলে শহরের ভানুগাছ সড়কে বিজিবি’র সেক্টর হেড কোয়ার্টার সংলগ্ন বটকুঞ্জের নিচ দিয়ে প্রবাহিত ভুরভুরিয়া ছড়ার পাশে এর অবস্থান। সম্প্রতি এখানে পর্যটকদের সুবিধার্থে নির্মিত হয়েছে ‘সীমান্ত ৭১ ফ্রেশ কর্নার’সহ মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘মৃত্যুঞ্জয়ী ৭১’। ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিস্তম্ভ্য ও একাত্তরের স্মৃতি বিজড়িত বধ্যভূমিটি দেখতে মানুষ আসতে থাকেন এখানে। বর্তমানে এ স্থানটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
এক দিকে স্বাধীনতার স্মৃতি, অন্যদিকে দৃষ্টি নন্দন স্থান দুই কারণে দিনে দিনে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে সাধুবাবার বটতলীতে প্রতিষ্ঠিত বধ্যভুমি একাত্তর হয়ে উঠছে জনপ্রিয় । বলাচলে শ্রীমঙ্গলের অর্ধ শতাধিক পর্যটন স্পটের মধ্যে এটি সর্বাধিক সৌন্দর্যমন্ডিত। আর এ স্পটটি শহরের কাছে এবং বিজিবি ক্যাম্পের নিরাপত্তা বলয়ে থাকায় প্রতিদিনই শত শত লোক ভীড় করছেন সেখানে। উপভোগ করছেন আনন্দ তবে মহান মুক্তিযুদ্ধের নির্মম ইতিহাস জানার মতো নেই কোনও ব্যবস্থা বা নাম ফলক। যাদের হত্যা করে এখানে ফেলে গণ কবর দেয়া হয়েছিল তাদের নাম ফলক ও স্থানটি উপেক্ষিত। নতুন প্রজন্ম অনেকেই সেখানে যান বিনোদনের জন্য,বধ্যভূমি কি এবং কেন এটা তারা জানেন না।
কালের সাক্ষি হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে সেই বট বৃক্ষ যদিও তার অনেকগুলো ডালপালা কেটে ফেলা হয়েছে। যেটি সাধুবাবার থলির বটবৃক্ষ নামে পরিচিত। যার নিচে ও ডালে ঝুলিয়ে ১৯৭১ সালে হত্যা করা হয়েছিলো শতশত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষকে। কয়েক বছর আগে বিজিবি ও শ্রীমঙ্গলবাসীর ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে এটিকে সংরক্ষন করে উন্মুক্ত করে দেয়া হয় জনসাধারণের জন্য। মৌলভীবাজারে ৬৫টি বদ্ধভূমি রয়েছে। এর মধ্যে এই বধ্যভুমি অন্যতম। এখানে একটি ফলক ও মুত্যুঞ্জয় ৭১ নামে একটি ভাস্কর্য্য তৈরী করা হয়েছে। কিন্তু যারা প্রাণ দিলো তাদের নাম ফলকগুলো অদৃশ্যমান জায়গায় আর যারা এটি সংস্কার করেছেন তাদের নাম ফলক বড় করে প্রবেশ দ্বারে লাগানো হয়েছে। বধ্যভূমি ৭১ কে ঘিরে এখানে বিজিবি’র দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সেখান থেকে প্রতি মাসে স্থানটির উন্নয়নের জন্য ১০ হাজার টাকা নাকি বরাদ্ধ দেয়া হয়। অথচ এখানে শহীদদের কোনও উন্নয়ন না করে পিকনিক স্পটের জন্য বিভিন্ন স্থাপনা তৈরী করা হচ্ছে। এখানে কপোত-কপোতিরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অনেক বাবা মা তাদের সন্তানদের নিয়ে এখানে বেড়াতে এলেও তারা ছবি তোলা ও বেড়ানো নিয়ে ব্যস্ত। শহীদদের যেখানে গণ কবর দেয়া হয়েছে সেখানে ১২ জনের ছোট ছোট করে নাম ফলক লাগানো হয়েছে সেটি ভাল করে খেয়াল না করলে দেখা যায়না। একটি ওভারব্রিজ তৈরী করা হয়েছে যেখান দিয়ে প্রতিদিন শতশত মানুষ ঢুকে অথচ তার ঠিক নিচেই ওরা শায়িত, মনে হয় যেন মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি পদ দলিত।
স্কুল কলেজ পড়ুয়া নুসরাত হামিদ ফাহিন, মীমসহ আরও অনেকে বলেন এটি মুক্তিযোদ্ধাদের গণ কবরের স্থান হলেও এটিকে পিকনিক স্পট মনে হয়, এটাকে আরও সংরক্ষন করা প্রয়োজন। অনেকে বলেন এটি পিকনিক স্পট জেনেই এসেছেন।
এস আলম সুমনসহ অনেকে বলেন এটিকে আরও সংরক্ষন করে এটির ঐতিহ্য তোলে ধরা প্রয়োজন। তাহলেই সবাই জানবে এর মূল রহস্য কি বা কেনও এটা করা হয়েছে। শুধু জনগণ আসলেই যে এটি প্রসিদ্ধ হয়ে গেল তা না, মুক্তিযোদ্ধাদের গণ কবরকে পূঁজি করে এখানে ব্যবস্যা করা হচ্ছে বলেও জানান অনেকে।
মুক্তিযোদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক ও বধ্যভূমি ৭১ এর সাথে জড়িত সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী ময়লা আবর্জনা ও ঠিক মতো সংরক্ষন হচ্ছেনা কথাটি স্বীকার করে বলেন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এখানে একটি আর্কাইব গড়ে তোলা হবে এবং এটির আরও সংরক্ষনের ব্যবস্খা নেয়া হবে।
সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কুমুদ রঞ্জন দেব বলেন স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতায় ও বিজিবি’র তৎকালিন কর্ণেল বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাকির সাহেব এর সহযোগিতায় এটি স্থাপন করা হয়েছে। তিনি এটির পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি বলেও জানান। তিনি বলেন প্রতি মাসে বিজিবি’র দু’টি দোকান থেকে ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হয় যা এখানকার উন্নয়ন কাজে লাগে।
মুক্তিযোদ্ধা বধ্যভূমি ৭১ এর স্মৃতি সংরক্ষন কমিটির অন্যতম বিরাজ সেন তরুন বলেন, বিদেশ থেকে এসে এটি সংরক্ষনের উদ্যোগ গ্রহন করেন। এখানে এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও বিজিবি সহযোগিতা করে যাচ্ছে। তিনি বলেন যতদিন তেনি বেঁচে থাকবেন ততদিন এটির কাজ চালিয়ে যাবেন।
তবে এব্যাপারে বিজিবি’র কেহ কথা বলতে চাননি। মেজর শাহিন মোবাইল ফোনে এপ্রতিনিধিকে বলেন, যা দেখছেন তাই, তার বাইরে কিছু বলা যাবেনা।
এরকম ঐক্যবধ্য প্রয়াসে সরকারের পাশাপাশি এর উন্নয়নসহ সঠিক মূল্যায়ন ও মৌলভীবাজারের বাকী বধ্যভুমি গুলোও সংরক্ষিত হবে এমনটাই চাওয়া এ জেলার স্বাধীনচেতা মানুষের।