নড়াইলের অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে জরাজীর্ণ ঘরে বসবাস করছে আশ্রয়নের বাসিন্দারা দূরাবস্থা

0
391

উজ্জ্বল রায় নড়াইল জেলা প্রতিনিধি: নড়াইলের চিত্রা আশ্রয়ন প্রকল্পে চরম দূরাবস্থা বিরাজ করছে। সদর উপজেলার আউড়িয়া ইউনিয়নের নাকসি বাজার সংলগ্ন এ আশ্রয়নে আবাসন সমস্যা প্রকট আকার ধারন করেছে। নাগরিক সুবিধা বলতে কিছুই নেই। অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে জরাজীর্ণ ঘরে বসবাস করছে আশ্রয়নের বাসিন্দারা। নোংরা পরিবেশে থাকায় তাদের অধিকাংশই রোগগ্রস্থ। রাজনৈতীক নেতা বা কোন সরকারি কর্মকর্তা তাদের খবর নেয় না বলে তাদের অভিযোগ। গত ১৯৯৮ সালে আশ্রয়ন প্রকল্প শুরু হয়। ১৪টা ব্যারাক আছে। প্রতিটি ব্যারাকে ১০টি করে রুম আছে। প্রতিটি রুমে ১টি পরিবার থাকে। সেখানে বর্তমান ১২৭ টি পরিবার বসবস করছে। প্রতিটি ব্যারাকের জন্য ১টি মাত্র শৌচাগার আছে। অধিকাংশ শৌচাগার একেবারেই অকেজো। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। যে গুলি ব্যবহার হচ্ছে তাও খুব নাজুব অবস্থা। একটি শৌচাগার ভালো নেই। একেবারেই ব্যবহার অনুপযোগি চৌচাগার ব্যবহার করতে তারা বাধ্য হচ্ছে। অনুষ্ঠানাদি পরিচালনার জন্য ২টি কমিউনিটি সেন্টার করা হয়। যার একটিতে গণ শিক্ষা কার্যক্রম চলে। আরেকটিতে আশ্রয়ন প্রকল্পের শিশু শিক্ষার্থীরা সকাল সন্ধ্যা পড়াশুনা করে। তাদেরকে বিনা পারিশ্রমিকে পড়ায় আশ্রয়নের আব্দুল্লাহ ও ওই এলাকার সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক গৃহবধূ বর্ষা খাতুন। আব্দুল্লাহ হিসাব বিজ্ঞানে অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। আব্দুল্লাহর বৃদ্ধ মা অন্যের সহযোগিতা নিয়ে তাকে পড়িয়েছে। প্রতিটি ব্যারাকই বসবাসের অনুপযোগি। প্রত্যেকটি ঘর নষ্ট হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে প্রত্যেকটি ঘর দিয়ে পানি পড়ে। টিনের বেড়া গুলি নষ্ট হয়ে গেছে। ঘরের চালা নেই ঠিকমত। যা আছে তার সারা জায়গা ফুটো ফুটো। অনেকে চালায় পলিথিন দিয়ে রেখেছে। বেড়া নষ্ট হওয়ায় পাটকাঠি দিয়ে বেড়া দিয়েছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ চটের ছালা টানিয়ে রেখেছেন। দরজা জানালা ঠিক নেই। প্রত্যেকটি জানালা দরজা ভাঙ্গা। নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। বউ ও বয়স্ক মেয়েদের নিয়ে পর্দায় থাকা তাদের জন্য বড়ই কঠিন। প্রত্যেক পরিবারের জন্য একটি ঘর বরাদ্দ হওয়ায় যে পরিবারে সদস্য বেশি তাদের ঠাসাঠাসি করে থাকতে হয়। আশ্রয়ন প্রকল্প এলাকা নিচু জায়গা হওয়ায় বসবাস করা খুবই কঠিন। সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, শীতকালেও শ্যাত শ্যেতে অবস্থা। একেতো নিচু জায়গা, তারপর আবার পানি নিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা নেই। একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায় আশ্রয়ন এলাকায়। চলাচলে খুব সমস্যা হয়। ১৩ ও ১৪ নং ব্যারাকের সামনে প্রায় সারা বছর পানি বেধে থাকে। এ দু’টি ব্যারাকের শিশুরা ঘরের বেড়া ধরে খুব কষ্টে চলাচল করে। তারা জন্ম থেকে বেঁেচ থাকার যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এ দু’টি ব্যারাকে শুরু থেকেই বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। ছেলে মেয়েরা কেরোসিনের ল্যাম্পের আলোয় পড়াশুনা করে। সামান্য বৃষ্টিতেই পানি জমে থৈ থৈ অবস্থা হয়। নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত থাকায় সেখানে বসবাসের কোন পরিবেশ নেই। বাধ্য হয়ে কয়েকটি পরিবার অন্যত্র চলে গেছে। আশ্রয়ন প্রকল্পের পাশের কবরস্থানে বর্ষা মৌসুম সহ প্রায় ৮ মাস পানি জমে থাকে। এ কারনে কেউ মারা গেলে দাফন করা খুব দুস্কর হয়ে পড়ে। এসব সমস্যার কারনে তাদের সন্তানদের বিয়ে দিতে পারছেন না। কেউ তাদের সাথে আতিœয়তা করতে চায়না বলে তারা জানান। অতিদরিদ্র এসব মানুষেরা ইউনিয়ন পরিষদ বা অন্য কোন দপ্তর হতে কোন সুবিধা পান না বলে জানান। তাদের সন্তানদের পড়াশুনার ব্যাপারেও কেউ সহায়তা করে না। অনেক কষ্টে তারা পড়াশুনা করে। তাদেরকে অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। ১৪ নম্বর ব্যারাকের ১০ নং কক্ষে থাকেন মুক্তিযোদ্ধা মোবারক হোসেন। তিনি স্ত্রী ঝর্না বেগমকে নিয়ে এখানে থাকেন। তাদের দুই কন্যা কন্যা ময়না ও টিয়া কে বিয়ে দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেলেও সংসারে আয়োক্ষম কেউ না থাকায় তাদের সংসার চলে অতিকষ্টে। মৃত মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান সিকদারের স্ত্রী ছেকেলা বিবি এবং দুই ছেলে সবুজ (২৫) ও সুপার (২২) থাকে ১০ নং ব্যারাকের ৩ নং কক্ষে। অর্থাভাবে দুই ছেলের কেউই বেশি দূর পড়াশুনা করতে পারেননি। ছেলেদের ছোট একটি চাকুরীর জন্য অনেকের কাছে গিয়েছেন। কেউ তাদের চাকুরী দেয়নি। অন্যের ক্ষেতে কাজ করে তারা জীবীকা নির্বাহ করে। এ প্রকল্প তৈরীর সময় চিত্রা আশ্রয়ন প্রকল্প বহুমুখি সমবায় সমিতি লিঃ নামে একটি সমিতি গঠন করা হয়। প্রকল্প চালুর সময় স্থানীয় কিছু সম্পদশালী লোক আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘরে উঠে। বিভিন্ন এলাকা হতেও কিছু সম্পদশালী লোক এসে বসবাস শুরু করে। তারা এ সমিতি থেকে ঋণ নেয়। অনেকেই ঋণ পরিশোধ না করে চলে যায়। পরবর্তীতে যারা আশ্রয়ন প্রকল্পে এসেছেন তাদের কাউকেই সদস্য করা হয়নি। মোঃ লিটন মেল্যা জানান, তিনি মাইজপাড়া ইউনিয়নের আদমপুর গ্রাম থেকে ১০ বছর আগে আশ্রয়ন প্রকল্পে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর মত অনেকেই দীর্ঘ দিন ধরে আছেন। তাদের কাউকেই সমিতির সদস্য করা হয়নি। শুরুতে সমিতির সদস্য ছিলেন ২০৫ জন। বর্তমান সদস্য আছেন ৫৫জন। নতুন করে কাউকেই সদস্য করা হচ্ছে না। সমিতির সভাপতি শহীদ হাওলাদার এবং সাধারণ নজরুল খন্দকারের কাছে গেলে তারা জানায় সমবায় অফিসারের কাছে যান। আর সদর উপজেলা সমবায় অফিসার তরিকুল ইসলাম বলেন,যার নামে ঘরের বরাদ্দ নেই তিনি সদস্য হতে পারবেন না। নিজেদের নামে ঘরের বরাদ্দ নেয়ার জন্য অসংখ্যবার নায়েব অফিস, এসিল্যান্ড ও ডিসি অফিস গিয়েছেন। অনেকবার ইউএনও’র নিকট গিয়েছেন কিন্তু কোন কাজ হয়নি। আউড়িয়া ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তা নূর ইসলামের কাছে গিয়েছেন অনেকবার। তার আগে যারা দ্বায়িত্বে ছিলেন তাদের নিকট গিয়েছেন অনেকবার। কেউই কোন সুরাহা করে যাননি। সকলেই উপরের কর্মকর্তাদের কথা বলে চলে গেছেন। লিটনের মত কাগজপত্র বিহীন অবস্থায় ১৩ নম্বর ব্যারাকে আছেন সিদ্দিক হোসেন (৫০)। তিনি এ ব্যারাকের ৫ নম্বর কক্ষে আছেন এক যুগ ধরে। শুকুর মোল্যা ৫ নম্বর ব্যারাকের ১ নং কক্ষে আছেন গত ৮ বছর যাবত। এ ব্যারাকের ২ নং কক্ষে আল আমিন মোল্যা (৩০) আছেন ৭ বছর যাবত। ৩ নং কক্ষে ৬ বছর ধরে আছেন জামাল হোসে (৩৫)। ৯ নং ব্যারাকের ৮ নং কক্ষে বিপুল মোল্যা (৩৬) আছেন এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। ১০ নং ব্যারাকের ৫ নং কক্ষে আছেন মাসুম হোসেন (৪৫) দীর্ঘ ৭ বছর ধরে। এদের মত প্রায় ১শ টি পরিবার আছেন, যাদের নামে কোন ঘরের বরাদ্দ নেই। আর নিজ নামে ঘরের বরাদ্দ না থাকায় তারা সমবায় সমিতির সদস্য হতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে তাদের বাইরের বিভিন্ন এনজিও হতে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়। আশ্রয়ন প্রকল্পের মধ্যে এনজিও প্রতিষ্ঠানের ঋণ দেয়া নিষেধ। সে কারনে কোন এনজিও তাদের ঋণ দিতে চান না। তাই অনেক সময় এনজিও কর্মীকে ঘুষ দিয়ে চড়া সুদের ঋণ নিতে তারা বাধ্য হন। এতে আশ্রয়ন প্রকল্পের অতি দরিদ্ররা আরো দারিদ্রের শিকার হচ্ছেন। আশ্রয়নের লিটন জানান, সে বাস শ্রমিক ছিল। দূর্ঘটনার শিকার হয়ে তার ডান পা অকেজো হয়ে গেছে। অর্থাভাবে ঠিকমত চিকিৎসা নিতে পারেনি। শারীরিক প্রতিবন্ধি হওয়ায় সে কোন কাজ করতে পারে না। পায়ের চিকিৎসার জন্য ডিসি অফিস সহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেছেন। জেলা পরিষদ হতে মাত্র ৫ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। তার স্ত্রী ফিরোজা বেগম একটি সেলাই মেশিনের জন্য বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরেছেন দিনের পর দিন। কিন্তু পাননি। সেলাই মেশিন পেলে কাজ করে সংসার চালাতে পারতেন বলে জানান ফিরোজা। প্রতিটি পরিবারেরই এমন দূরাবস্থার কথা তারা জানান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ আশ্রয়নের একাধিক ব্যক্তি জানান,ডিসি অফিসের ডিডি এলজি’র দ্বায়িত্বে থাকা মোঃ সিদ্দিকুর রহমান প্রায় ২ বছর আগে এ আশ্রয়নের ৭/৮ জন ভিক্ষুককে সামান্য সহযোগিতা করেছিলেন। তাদের ভিক্ষা বন্ধ করার জন্য। ওই সামান্য সহযোগিতায় কারো চলে না। তাই সে সময় অনেকেই ভিক্ষার কথা গোপন রাখেন। গোপনে বিভিন্ন লোকের সহযোগিতা নিয়ে তারা জীবীকা নির্বাহ করছেন। আক্ষেপের সাথে বলেন, এমন বিপদ যে প্রকাশ্যে ভিক্ষা করার কোন কায়দা নেই। কারণ ভিক্ষা করতে গেলে ধরে জেলে দেয় প্রশাসনের লোকেরা। তাই ভয়ে গোপনে অন্যের সাহায্য নিতে হয়। এতে তারা আরোও বিপদে আছেন বলে জানান। ভয়ে অনেকে তাদের ভিক্ষা করার কথা গোপন রাখেন। কিন্তু আশ্রয়নের অন্যরা বলেন, প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে পেটের দায়ে আরোও অন্ততঃ ১০ জন ভিক্ষা করে। তবে তারা ধরা পড়ার ভয়ে এলাকার বাইরে চলে যায়। ক্যামেরায় ছবি নেয়া হবে না এবং তাদের নাম প্রকাশ করা হবে না, এমন শর্তে দুঃখের সাথে জানান, ৪টি হাসের বাচ্চা, আর ১টি ছাগল দিয়ে কোন দিন সংসার চলে না। তাই এসব দিয়ে ভিক্ষা বন্ধ হয় না। অথচ এসব দিয়ে ভিক্ষা বন্ধ করতে বলেন প্রশাসনের কর্তারা। এটাকি সম্ভব? আবার কাউকে ওজন মাপার যন্ত্র দিয়েছেন,কাউকে বাদাম বা অন্য ছোট ব্যবসার ব্যবস্থা করেছেন। যা করেছেন, তা কোনভাবেই একটা সংসারের জন্য যথেষ্ট নয়। এ কাজ করে কোন কোন পরিবারকে ভালো করলেও,অনেক পরিবারের দুঃখ দূর্দশা বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে তারা দাবি করেন। আশ্রয়নের একাধিক বাসিন্দা জানান, একাধিকবার ডিসি অফিসের সিদ্দিকুর রহমান স্যার বিভিন্ন সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু কোন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেন নি। এসব বিষয়ে জানার জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মোঃ সিদ্দিকুর রহমানকে শনিবার বেলা ২টা ৪৭ মিনিটে তার মোবাইল নং ০১৭১২৫৭০০৫৪ কল দিলে তিনি রিসিভ না করে কেটে দেন।
খবর৭১/জি:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here