হাবিবুর রহমান নাসির, ছাতক (সুনামগঞ্জ):
বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে এক সময়ে নৌকা ছিল পরিবহন, যাতায়াতসহ জীবন যাপনের এক অপরিহার্য উপাদান। বর্ষাকালে মানুষের যাতায়াত ও দৈনন্দিন জীবন নৌকা ছাড়া ভাবাই যেতো না। বিশেষ করে হাওর, নদী-নালা, খাল ও বিলের ধারে যারা বসবাস করতেন তাদের প্রত্যেকেরই থাকতো কাঠের তৈরী নিজ নিজ নৌকা। নৌকা চালনার জন্য সকলের ঘরে থাকতো দাঁড়, লগি ও বৈঠা। বড় নৌকায় থাকতো পাল তোলার মাস’ুল ও গুন টানার লম্বা রশি। যাদের নৌকা ক্রয় বা বানানোর সাম্যর্থ ছিলনা তারা নৌকার পরিবর্তে কলা গাছের ভেলা বা কোথাও তাল গাছের কোন্দা বানাতেন। বিয়ে-শাদী, ঈদ, পূজা-পার্বণ বা যেকোন উৎসবে সে সময় নৌকাই ছিল একমাত্র বাহন। বিশেষ করে বিয়ের বায়না পেলে নৌকা চালকরা হতেন মহাখুশী। বর্ষা এলে ধুম পড়ে যেতো পালা করে আত্নীয়-স্বজনের বাড়ীতে নৌকায় বেড়ানোর। দূরের আত্নীয়রা অপেক্ষার প্রহর গুনতেন বর্ষার আগমনের। তখনকার সময়ে আত্নীয়-স্বজনের বাড়ীতে মানুষ মাসাধিকাল পর্যন-ও অবস’ান করত। কিছু দিন পূর্বেও বর্তমান সময়ের মতো যত্রতত্র দোকান বা বাজার ছিল না। হাট-বাজারের নির্দিষ্ট বার আসার আগে যাদের নিজস্ব নৌকা থাকতো না তারা বাজারে যেতে আগের দিন কারো সঙ্গীঁ হয়ে যেতেন। হাওর বা খাল-বিলের কোলাহল মুক্ত বাতাসে বিকেল বেলায় নৌকায় বেড়ানোর আনন্দই ছিল এক ভিন্নতা। এতে ক্ষতিকর সামাজিক কু-চিন-া মানুষকে খুব কমই নৈতিক, চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ স্খলনের দিকে নিতে পারতো। কালের আবর্তে বাংলাদেশের গ্রামীন জনপদে নৌকার প্রচলন প্রায় বিলুপ্তের পথে। কিছুদিন পর হয়ত আমাদের প্রজন্মদের নৌকা দেখতে যেতে হবে যাদুঘরে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তসহ অনেক সাহিত্যিকের রচনা-কাব্যে নৌকার উপসি’তি ছিল প্রখর ও স্পষ্ট। রবীন্দ্রনাথের সোনারতরী কবিতায় নৌকার রয়েছে স্বপ্নীল মাধুর্যপূর্ণ স্মৃতি। হাটবাজার থেকে শুরু করে কৃষকের গবাদিপশু পারাপার, ধান-পাট আনয়নসহ গৃহস’ালি কাজে নৌকা ছাড়া সবই ছিল অচল। কৃষকের এ দৃশ্য দেখে রবীন্দ্রনাথ বাংলা কাব্যে লিখেছেন “ডিঙ্গীঁ চড়ে আসে চাষী কেটে লয় ধান বেলা গেলে গাঁয়ে ফিরে গেয়ে সারি গান”। নৌকার প্রচলন কমে যাওয়ায় হরিয়ে যাচ্ছে হাওর, নদী, খাল-বিল থেকে বাতাসে ওড়া মাঝিদের ভাটিয়ালী, সারি ও ভাওয়াইয়া গানের মন মাতানো সুর। এ ধরনের গান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মাঝে মধ্যে শোনা গেলেও ভিনদেশী আকাশ সংস্কৃতির থাবায় হয়ত একদিন সাংস্কৃতিক অঙ্গঁন থেকে তা মুছে যেতে পারে। ব্যবহারের ক্ষেত্রে নৌকার পরিচিতির জন্যে ভিন্ন ভিন্ন নাম থাকতো। সাম্পান নৌকা ছিল চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচিত নৌকার নাম। চট্টগ্রাম, মহেশখালী, কুতুবদিয়া এলাকা ও কর্ণফুলী নদীতে সাম্পানের চলাচল ছিল বেশী। এই সাম্পান নৌকা দিয়েও রচিত হয়েছে অনেক গান ও কবিতা। সাম্পান নৌকার মাঝিকে নিয়ে রচিত চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনপ্রিয় লোকগান “ওরে সাম্পান ওয়ালা-তুই আমারে করলি দিওয়ানা” গানটি কিংবদনি- কন্ঠশিল্পী শেফালী ঘোষের কন্ঠে গাওয়া সেই উদাসী সুর আজও সংস্কৃতি প্রেমীদের কাছে অতিপ্রিয়। বরিশাল, কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে বেশী দেখা যেত গয়না নৌকা। স্বল্প দূরত্বের পারাপারে মানুষের একমাত্র বাহন ছিল এ গয়না নৌকা। কুষ্টিয়া অঞ্জলে ব্যবসা-বানিজ্যের কাজে ব্যবহৃত হতো বালার নামে এক ধরনের নৌকা। ১২থেকে ১৫টন পর্যন- মালামাল বহন করা যেতো এ নৌকায়। ব্যবসার কাজে খুলনা অঞ্চলে ব্যবহৃত হতো বাতনাই বা লম্বাপদি নৌকা। এতে ১৪০থেকে ১৬০টন মালামাল বহন করা যেতো। প্রায় ২০জন মাঝি-মাল্লা এ নৌকা চালাতে হতো। এ ধরনের বাতনাই নৌকা বর্তমানে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। সেকালে রাজা-বাদশাহ, জমিদার বা সৌখিন ধনাঢ্যদের ভ্রমনের নৌকার নাম ছিল ময়ূরপঙ্খী। এ জন্য ময়ুরপঙ্খী নৌকাকে বলা হয় নৌকার রাজা। চলবে।
খবর ৭১/ এস: