খবর৭১:অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছি। তখন আমার বয়স মাত্র ২২ বছর।
রেজাল্টের পরের দিন আর তর সহ্য হচ্ছিল না। বার বার বাড়ি ফিরে যেতে মন চাচ্ছিল। জানি না ঠিক কী কারণে মন একটু খারাপও ছিল।
সেটা হতে পারে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ফেলার কারণে, আবার পরবর্তী জীবন নিয়ে দুঃশ্চিনার কারণেও হতে পারে। তবে আমি বেশ উত্তেজিত ছিলাম।
যাই হোক, বাড়ি ফিরে যাওয়ার কারণে আমি ব্যাকুল ছিলাম। সেটা জুন মাসের ঘটনা। বাড়ি যাব ভাবতেই শরীর আর মন কেমন যেন গরম হয়ে উঠেছিল। সে কারণেই হয়তো দীর্ঘ সময় ধরে সাঁতার কেটে আসি।
তার পর বেরিয়ে পড়ি বাড়ির পথে। অক্সফোর্ড থেকে বের হওয়ার সময় ধীরে ধীরে গাড়ি চালালেও বাড়ি যাওয়ার জন্য একটু জোরে গাড়ি চালাতে থাকি।
একপর্যায়ে আমার বাড়ির এলাকায় এসে যাই। সেখানকার রাস্তায় গাড়ি চালানোর সর্বোচ্চ গতি ছিল ৪০ থেকে ৪৫ কিলোমিটার। তার পরেও আমি হয়তো একটু জোরেই গাড়ি চালাচ্ছিলাম।
একপর্যায়ে দেখি রাস্তার মাঝখানে ছোটো এক ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে। তার পরের মুহূর্তের মধ্যেই আমার গাড়ির সামনে ধাক্কা লেগে শূন্যে উড়ে উঠে ছিটকে পড়ে গেল বাচ্চাটা। আমি তো হতবাক হয়ে গেলাম।
ভাবলাম এমন নিষ্ঠুর কাজ কে করলো? বুঝলাম, আমার গাড়ির ধাক্কায় তার এমন পরিণতি হয়েছে। আমি বাকরুদ্ধ অবস্থায় গাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম।
ততোক্ষণে সেই ছেলের পাশে বহু মানুষ জড়ো হয়েছে। সেই ছেলের বাড়ি ছিল রাস্তার পাশেই। তার প্রতিবেশীরাও এসে হাজির হয়েছে ততোক্ষণে। অামি তাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য দ্রুত চেষ্টা করছিলাম।
তবে মিনিট বিশেকের মধ্যেই পুলিশ আসার পর দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। আর আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলাম। সবাই আমার গাড়িটা দেখতে পেল। কিন্তু চালক আমি তো তাদের পাশে দাঁড়িয়ে অাছি, সে কারণে আমাকে কেউ চালক ভাবতেও পারেনি।
কিন্তু আমি নিজেই পুলিশকে জানালাম, ধাক্কাটা আমার অসচেতনতার কারণেই লেগেছে। এর মধ্যে ওই ছেলের মা সেখানে হাজির হলো। তার হৃদয় বিদারক আহাজারি দেখে আমার তো গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল।
তিনি ছেলের সঙ্গে দেখা করতে যেতে চাইলেন। তবে প্রতিবেশিরা তাকে আটকে দিলেন। সেখানে থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল ওই সময়।
পুলিশ আমাকে সঙ্গে নিয়ে থানায় গেল। তার পর লিখিত বিবৃতি নিল আমার কাছ থেকে। তার পর কিছুক্ষণ বসিয়ে রেখে একজন কর্মকর্তা আমাকে জানালেন, ছেলেটি আর বেঁচে নেই।
কথাটা শোনার জন্য মোটেও অামি প্রস্তুত ছিলাম না। বার বার কেবল ছেলেটির মায়ের কথা মনে পড়ছিল। আমি কিছু না বলতেই ওই পুলিশ কর্মকর্তা আবার বললেন, আপনাকে আটক করছি না। তবে পরের বার রাস্তায় বের হলে সতর্ক থাকবেন, যেন এরকম ঘটনা আর না ঘটে।
আমি কেবল বলেছিলাম, ঠিক আছে। তার পর বাড়ি না গিয়ে অক্সফোর্ডে ফিরে যাই। তার পর মা-বাবাকে দ্রুত আসতে বলি। মাকে সব খুলে বলি। আবেগেই হয়তো বার বার বলতে থাকি, ‘মা সেটা একটা দুর্ঘটনা, আমি হত্যা করিনি। ‘
বার বার পাগলের মতো প্রলাপ বকতে থাকি। মা আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন আর বলছেন, ওটা তো আসলেও দুর্ঘটনা।
পরের দিন বাবা এসেও একই কথা বলেছেন। তবে আমার আর সেটা দুর্ঘটনা বলে মনে হয়নি। মনে হয় ওটা হত্যা। আমি যদি গাড়িটা ধীরে চালাতাম, সতর্ক থাকতাম, আবেগী না হতাম; তাহলে হয়তো ছেলেটা বেঁচে যেত।
ছেলের অভিভাবক যদি আমার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেন, সে ক্ষেত্রে আমাকে রক্ষার জন্য বাবা উকিলের মরামর্শও নিয়েছিলেন। তবে আমার কেবলই মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে আমি অপরাধী। আমার আবেগ, অসচেতনতার কারণে অকালে ঝরে গেছে একজনের প্রাণ।
(১৯৭৭ সালে দুর্ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন মারিয়ান গ্রে। তখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর ছিল। তিনি সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করেছেন বিবিসির কাছে।
খবর৭১/জি: