খবর৭১: ঘুষ বন্ধ করতে না পেরে সহনীয় মাত্রায় ঘুষ নিতে শিক্ষামন্ত্রী যে আকুতির পেছনে রয়েছে শিক্ষাখাতে দুর্নীতির করুণ চিত্র। সেখানে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে সহসা উত্তরণের আশা করাও এক ধরনের দুঃসাহসের বিষয়।
বিভিন্ন সরকারি অফিসে ঘুষ দুর্নীতির কারণে পকেটের টাকা খরচ করতে হচ্ছে শিক্ষক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে। আবার যারা অফিসে অফিসে ঘুষ দিয়ে বিরক্ত হন, তাদের অনেকেই আবার নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি করেন। ছাত্রদের কাছ থেকে আদায় করেন বাড়তি টাকা, টাকা আদায়ে এমন সব কৌশল আবিস্কার হয়েছে যা রীতিমত বিস্ময়কর।
স্কুলে ছাত্র ভর্তি, শিক্ষক নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, শিক্ষকের এমপিওভুক্ত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন, প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি, জাতীয়করণ এমনকি অবসরের পর পেনশনের টাকা তুলতে ঘুষ চলছে অবাধে। কোনো অভিযোগের তদন্তে কোনো দল গেলে তাদেরকেও ‘খুশি’ না করার উপায় থাকে না বলে জানিয়েছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানান, এই পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। বিভিন্ন খাতে জিডিটালাইজেশনে দুর্নীতি কমলেও এই খাতে তার ছোঁয়া লাগেনি। দুর্নীতিবাজের সংখ্যা এত বেশি যে ঠক বাছতে গা উজারের মতো অবস্থা।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, স্কুল থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পর্যন্ত পাঁচ থেকে ছয়টি ধাপে ১০ হাজার থেকে ক্ষেত্র বিশেষে আট লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়। এর প্রমাণও বিভিন্ন সময়ে তদন্তে মিলেছে। কিন্তু ফল হয়নি কোনো।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম অঞ্চলের এমপিও পেতে ব্যাপক দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর- মাউশির উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত দল। তবে দুর্নীতিবাজদের টলানো যায়নি।
ময়মনসিংহে আঞ্চলিক উপ-পরিচালকের বিরুদ্ধে দুই দফা তদন্তে বিস্তর দুর্নীতির প্রমাণ মিললেও বহাল তবিয়তে আছেন তিনি। আর ঢাকার উপ-পরিচালককে দুর্নীতির অভিযোগে দুই দফা বদলির নির্দেশ দিলেও সরানো যায়নি। ২০১৫ সালে সারা দেশের এমপিও নয়টি আঞ্চলিক অফিসে বিকেন্দ্রীকরণ করার পর শিক্ষক হয়রানি, ঘুষ লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে কয়েকগুণ।
এতো শুধু গেল এমপিও পেতে ঘুষের তথ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করতে অনন্ত ২০টি ঘাটে ঘুষের টাকা দিতে হয়। এনিয়ে তহবিল সংগ্রহের তথ্যও আছে।
এভাবে চাকরিতে নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, মাউশির পরিদর্শন-তদন্ত, বোর্ড পরিদর্শন-তদন্তসহ শিক্ষার প্রতিটি স্তরে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এসব দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টদের ৩৯টি সুপারিশ দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব সুপারিশে প্রশ্নপত্র ফাঁস, নোট বা গাইড, কোচিং বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ, এমপিওভুক্তি, নিয়োগ ও বদলিসহ বিভিন্ন দুর্নীতির উৎস এবং তা বন্ধের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে গঠিত ‘শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানিক টিম’এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ উল্লেখ করা হয়েছে।
এসব বিষয়ে দুদক সচিব শামসুল আরেফিন বলেন, ‘শিক্ষাখাতে ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম নিয়ে দুদক বিভিন্ন সুপারিশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। তারা সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে আশা করছি ঘুষ-দুর্নীতি কমবে।’
রবিবার পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) কর্মকর্তাদের সহনীয় মাত্রায় ঘুষ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘স্কুলে খাম তৈরি করা থাকে, আপনার কাজ হল আপনি গেলেন, গেলে আপনার খামটা আপনার হাতে ধরাই দিলে আপনি খাইয়্যা-দাইয়্যা তারপরে আসার সময় চলে আসবেন। আইস্যা রিপোর্ট দেবেন ঠিক আছে। তবে আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনারা ঘুষ খান, কিন্তু সহনীয় হয়ে খান। কেন না, আমার এটা বলার সাহসই নেই যে, ঘুষ খাবেন না। তা অর্থহীন হবে।’
শিক্ষা মন্ত্রীর এই সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খাওয়ার পরামর্শ দেয়ার পর সমালোচনার ঝড় তৈরি হয়েছে। তবে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে এই খাতে দুর্নীতির ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে। পাশাপাশি এই দুর্নীতি দূর করা কতটা কঠিন, সেটিও তুলে ধরেছেন তিনি।
মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমার মনে হয় তিনি হতাশা থেকে এসব কথা বলেছেন। ঘুষ বা উৎকোচ অল্প খাওয়া-বেশি হওয়া উভয়ই গর্হিত কাজ। এটাকে পরিত্যাগ করতে হবে।’
শিক্ষাখাতে দুর্নীতির কারণে কেবল শিক্ষক আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভুগছে তা নয়। শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও আছে দুর্নীতি-ঘুষের বিস্তর অভিযোগ।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে নিবন্ধন পরীক্ষায় পাসের শর্ত আরোপের পর যাতে তাকে নিয়োগের বিষয়টি বন্ধ হলেও এখনও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ মানেই ঘুষ-এই চিত্র পাল্টানো যায়নি। নিয়োগ পরীক্ষা এ ক্ষেত্রে লোক দেখানো বলেই প্রচার আছে। আবার শিক্ষক নিয়োগের পর তার এমপিও করিয়ে দেয়ার জন্য দিতে হয় টাকা।
এ ছাড়া সরকারি স্কুলে ইচ্ছামত এলাকায় বদলি মানেই হচ্ছে টাকা খরচ। এই টাকা মাউশি, মন্ত্রণালয়ের ডেস্কে ডেস্কে নানা অযুহাতে আটকে রাখা হয় ফাইল।
গত সপ্তাহে একজন শিক্ষকের বদলির আদেশ হওয়ার পর সেটি ওয়েবসাইটে তুলতে ওই শিক্ষককে দিতে হয়েছে ঘুষ। এই ঘুষ খেয়েছেন একজন কম্পিউটার অপারেটর।
কেন অভিযোগ করেননি, জানতে চাইলে ওই শিক্ষক বলেন, ‘অভিযোগ করে লাভ নাই। এসব হয়েই আসছে।’
আবার কেবল সুবিধামতো জায়গায় বদলি না, বদলি যেন না করা হয়, এ জন্যও ঘুষ দিয়ে থাকেন শিক্ষকরা।
সরকারি স্কুলে তিন বছর পর পর শিক্ষকদের বদলির নীতিমালা থাকলেও ঢাকার আট স্কুলের ৯৭ শিক্ষক একই স্কুলে দায়িত্ব পালন করছেন ১০ বছর থেকে ৩৩ বছর পর্যন্ত। সম্প্রতি দুদক এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছ।
চাকরি জীবন শেষে পেনশন ও ভবিষ্য তহবিলের টাকা তুলতে গেলে ঘুষ না দিলে দীর্ঘদিন আবেদন আটকে রাখার ঘটনাটি এখন আর গোপন নয়।
কিশোরগঞ্জ সদরের নগুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা অবসরে যাওয়ার পর তার পেনশনের টাকা চালু করতে দুই বারে তাকে খরচ করতে হয়েছে ২০ হাজার টাকা।
যে শিক্ষকরা নিজেরা বিভিন্ন কার্যালয়ে ঘুষ-দুর্নীতির শিকার, তাদের বিরুদ্ধে স্কুলে আছে নানা অভিযোগ। বিশেষ করে সহায়ক বই নির্বাচনের ক্ষেত্রে টাকার লেনদেন পুরনো অভিযোগ। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বই নির্বাচন করলেই শিক্ষার্থীরা তা কিনবে এটা নিশ্চিত। এ কারণে ঘুষ দিতে পিছপা হয় না প্রতিষ্ঠানগুলো।
আবার স্কুলে না পড়িয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিং বা প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য করেন শিক্ষকরা। এখন শিক্ষা ব্যবস্থায় স্কুলের পাশাপাশি এই বিষয়টি একটি অবশ্যম্ভাবী বিষয় হয়ে উঠেছে। দুদক যে ৯৭ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার সুপারিশ করেছে তাদের বিরুদ্ধেও এই কোচিং বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী একাধিকবার কোচিং বাণিজ্য বন্ধের ঘোষণা দিলেও তিনি কিছুই করতে পারেননি।
আবার স্কুলে সরকার নির্ধারিত বেতনের চেয়ে অতিরিক্ত আদায়, উন্নয়ন ফি বা অন্য কোনো নামে টাকা আদায়, এসএসসি ও এইচএসসির নিবন্ধনে বাড়তি টাকা আদায়ের বিরুদ্ধেও কার্যকর কোনো কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেনি মন্ত্রণালয় বা শিক্ষা বোর্ড।
আবার বিভিন্ন স্কুল তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে বই, খাতা, কলম, এমনকি পোশাক কিনতে বাধ্য করে।
প্রতি বছরের শুরুতে স্কুলে ভর্তির সময় অতিরিক্ত টাকা আদায় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়, আবার তা থেমেও যায়। বছর কয়েক আগে ঢাকার একটি বেসরকারি স্কুলে একজন নারী সাংবাদিককে লাঞ্ছনার পর এ নিয়ে কয়েকদিন হৈ চৈ হয়েছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তদন্তের পর সে সময় দেখা যায়, প্রায় সব স্কুলেই অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়। সে সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ পরিস্থিতি পাল্টে দেয়ার ঘোষণা দিলেও স্কুলগুলোর বিরুদ্ধে কার্যত কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেনি।
স্কুল কলেজের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও বিষয় অনুমোদনের জন্য চলে ঘুষ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি থেকে তদন্ত দলের পরিদর্শনের পরই কোনো একটি বিষয় খোলার অনুমোদন দেয়া হয়। আর এই তদন্ত দল বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে তাদের খুশি করতে হয়।
আবার অনুমোদন ছাড়াই অবৈধভাব কোনো বিষয়ে ছাত্র ভর্তির বিষয়ে গণমাধ্যমে অভিযোগ আসে নিয়মিত।
এসব বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, শিক্ষামন্ত্রী কম হতাশা থেকে এই কথা বলেনি। তিনি বলেন, ‘মন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে ঘুষ, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা নিয়ে বারবার কথা বলেছেন, নানা নির্দেশও দিয়েছেন। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাথমিক পর্যায় থেকে উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত ঘুষ-দুর্নীতির জাল এতটাই বেশি যে এ ক্ষেত্রে সামগ্রিক সংস্কার প্রয়োজন। পুরো পদ্ধতি পাল্টে না ফেললে কিছুই হবে না।’
খবর৭১/জি: