খবর৭১,মঈনুল হাসান রতন, হবিগঞ্জ প্রতিনিধি ঃ খেয়াই, করাঙ্গী, শুটকি, সোনাই ও সুতাং নদী ছাড়ও হবিগঞ্জে রয়েছে অসংখ্য আরও খাল-ক্ষল, হাওর, বাওড়, ডোবানালা। নদীগুলোকে ঘিরে লোকসমাজে প্রচলিত রয়েছে নানান কিংবদন্তি। তেমনিই একটি সুতাং নদী। শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার সুতাং নদীর ইতিকথা জানতে গিয়েছিলাম সুতাং পাড়ের বয়োবৃদ্ধ মানুষের কাছে। তেমনি একজন মানুষ মরমি সাহিত্যিক সৈয়দ গাজীউর রহমান (৭০)। বাড়ি সুতাং নদীর পশ্চিম পাড়ের সুরাবই গ্রামে। তিনি সুতাং সম্পর্কে জানান, ভারতের ত্রিপুরা থেকে সুতাং নদীর উৎপত্তি। হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার বাল্লা সীমান্ত হয়ে একই উপজেলার সুতাং বাজারের উত্তর দিক হয়ে রঘুনন্নদ পাহাড়ের পাড় ঘেষে আঁকাবাকা হয়ে বয়ে চলছে সুতাং এরপর শায়েস্তাগঞ্জের সুতাং বাজার ঘেষে বেলেম্বরী নামক স্থান দিয়ে লাখাই উপজেলার মধ্য দিয়ে ঝনঝনি নামে মেঘনার শাখা নদীতে মিলত হয়েছে। সুতাং এলাকার পুরাসুন্দা গ্রামের লেখক-সাংবাদিক সমুজ আলী আহমদ জানান, সুতাং নদী নিয়ে কিংবদন্তি আছে যে, শায়েস্তা খান বহু দেশ বিজয়ের উদ্দেশে বারবার সেনা পাঠিয়েছিলেন সুতাং নদী দিয়ে। সেনা সৈন্যরা সুতাংয়ে এসে রাত যাপন করত। সেই সময় যুদ্ধে মৃতুবরণকারী সেনাদের লাশ সুতাং নদী দিয়ে ভাসানো হতো। তিনি আরও জানান, সুতাং নদীর বেশ কয়টি শাখা-প্রশাখা ধারণে করে ছড়া থৈরি হয়েছে। তেলখ ছড়া, গাদা ছড়া, দেউন্দি ছড়া, বদরগাজী ছড়া। ঐসব ছড়ারা সাদা বালু এ অঞ্চলের মানুষের ঘরবাড়ি নির্মাণের কাজে লাগে। চরার বালু বিক্রি করে অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করছে। একসময় সুতাং নদীতে প্রচুর চিতল মাছ আসত। কালের আবর্তনে চিতল মাছ আর সুতাং নদীতে দেখা যায় না। সুতাং নদীর পুটিমাছ ছিল প্রসিদ্ধ। এখন লোকমুখে শোনা যায়, ‘চাইল্যার বিলের কৈ’ সুতাংয়ের পুটিমাছ গেল কই’। সুতাংকে ঘিরে বেশ কয়েকটি হাট বাজার গড়ে উঠেছে। যেমন সুতাং াজার, বাছিরগঞ্চ বাজার, সাধু বাজার, উচাইল বাজার, বুল্লা বাজার। বর্ষাকালে নদীতে যখন পানি বাড়ে তখন মাদনা, আদমপুর, বুল্লা, অষ্টগ্রাম, মিঠামইন, নাসিরনগর থেকে বিভিন্ন পেশার ব্যবসায়ীরা নৌকাযোগে সুতাং বাজারে আসতেন নানান পণ্যের পসরা নিয়ে। গ্রাম- বাংলার ঐতিহ্য নৌকা বাইচ দেখা যেত সুতাং নদীতে সুতাং এলাকার বাশ বেশ প্রসিদ্ধ। সুতাং নদী দিয়ে বাঁশের চালি ভাসিয়ে নেয়া হতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। সুতাং পাড়ের পুরাসুন্দা গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম তালুকদার ওরফে ইনু মিয়া জানান, সুতাং একটি উপজাতীয় শব্দ। এক সময় সুতাং নদীর পড়ে বসবা ছিল উপজাতিদের। তাদের মতে, নদীটি সুতার মতো আঁকাবাকা হয়ে বয়ে চলার কারণে এর নাম সুতাং নদী। শত শত বছর আগের প্রাচীন নদী সুতাং। এ নদীর নাব্য হারিয়ে গেছে। নদী আগের চেয়ে অনেক শীর্ণকায় হয়েছে এক শ্রেণীর ভূমি দখলদারে কবলে পড়ে সুতাং পাড়ের চাঁনপুর গ্রামের মৎস্য খামারি মোঃ আবদুল মালেক জানান, সুতাং নদীকে কেন্দ্র করে কয়েকটি গ্রামের শতাধিক মৎস্যজীবি তাদের জীবিক নির্বাহ করছে। মৎস্যজীবিরা জানান, নদীতে নাব্যতা না থাকায় সময়মত পোনা চাষ করা যায় না। সুতাং নদীর পড়ে সুরাবই ও কাটাখালী গ্রামে বসতি গড়েছে কুমার সম্প্রদায়।তারা সারা বছর মাটির তৈরী জিনিস সুতাং নদী দিয়ে নৌকাযোগে জেলার বিভিন্ন স্থানে নিয়ে বিক্রি করে। সুতাং নদীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, সুতাং নদীর উপর দিয়ে ঢাকা-সিলেট রেলপথ ও মহাসড়ক, শায়েস্তাগঞ্জ-জগদীশপুর সড়ক ছাড়াও আরও ছোট ছোট সড়ক আছে। নদীর নামে সুতাং বাজারে বেশ কয়েকটি সংগঠন গড়ে উঠেছে। সুতাং থিয়েটার নামে একটি সামাজিক -সাংস্কৃতিক সংগঠন এলাকায় কাজ করছে। সুতাং নদীর পাড়ে প্রতি বাংলা বছরের চৈত্র মাসে ঐতিহ্যবাহী বেলশ্বরী বান্নি বসে। বিখ্যাত শরৎ বাউল একবার গানে গানে বলছিলেন – ‘‘ সুরাবই আর পুরাসুন্দা একঘর শেখ, তিনঘর, দাস, বাকি সব তেঁতুল আর বাঁশ। এই বাউলের গানেই প্রমাণ করে সুতাং এলাকার বাশের জনপ্রিয়তা। হাজারো বছরের ঐতিহ্য বহন করে আছে সুতাং বাজারের বাশের হাট। এ বাঁশ এলাকার চাহিদা মিটিয়ে বহু দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত হচ্ছে। সুতাং বাজার বাশের জন্য বিখ্যাত। সুতাং সুরাবই গ্রামের (সাহেব বাড়ি) সৈয়দ গাজীউর রহমান জানান, এ এলাকায় পর্যাপ্ত বাশ থাকার কারণে বাশ-বেতের সমন্বয়ে কুটির শিল্প তৈরি করে অনেক পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছে। জানা যায়, বাজারের পাশ্বর্তী পুরানুস্দা ও সুরাবই গ্রামে প্রায় ৩ হাজার একর জমিতে বাশের বাগান আছে। এখানকার বাশের জনপ্রিয়তার কথা সবারই জানা। বাগানে বেশ কয়েক প্রজাতির বাশ উৎপাদন হয়। বাকল, বউরা, মুলি, কনকই বাশ উল্লেখযোগ্য। প্রতিটি বাশ ৪০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। সর্বশেষে স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী বেলাল জানান, ৫-৭ বছর আগে হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন নদী খননেরে জন্য সার্ভে করে যায়। কিন্তু সুতাং নদী খনন কেন হচ্ছে না জানা যায়নি। নামে মাত্র কিছু স্থানে কাজ করা হয়েছিল। সুতাং পাড়ের কৃষিজীবি মানুষ জানান, খরা মৌসুমে জমি শুকিয়ে যায়। নদীতে ও পানি থাকে না। তাই নদী খনন করা হলে এলাকার কৃষক বাঁচবে, বাঁচবে দেশ। উপকৃত হবে দেশের কৃষি অর্থনীতি। সুতাং পাড়ের সব পেশাজীবি মানুষের জোরারো দাবি, ঐতিহ্যবাহী সুতাং নদী পুনর্খনন করে তার হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে দেয়া হোক।
খবর৭১/জি: