শেখ কাজিম উদ্দিন, বেনাপোল : অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহনের অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার বেনাপোল চেকপোষ্ট কাষ্টমস তল্লাশী কেন্দ্র থেকে ৩ কাষ্টমস্ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হলেও থেমে নেই নতুন দ্বায়িত্বে আসা কাস্টমস কর্মকর্তাদের। প্রত্যাহার না হওয়া অণ্যান্য সকল কাস্টমস কর্মকর্তাদের সমন্ময়ে প্রত্যাহার হওয়ার ভয় না করে নতুনরাও মেতেছেন প্রথাগত রমরমা ঘুষ বাণিজ্যে। বিগত দিনের অনিয়ম-দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্য অন্ধকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন প্রকাশ্যে হওয়ায় ভয়ে এপথ ছাড়তে বসেছেন অধিকাংশ পাসপোর্ট যাত্রীরা।
বিভিন্ন পাসপোর্ট যাত্রীদের অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিনে যাওয়া হয় চেকপোস্ট কাস্টমস তল্লাশী কেন্দ্র এলাকায়। রবিবার ঠিক বিকাল ৪টার আগ মুহুর্ত। তল্লাশী কেন্দ্রের মেইন ফটকে দাড়িয়ে আছেন কাস্টমস সুপার স্বপন কুমার সিংহ। ভিতরে ল্যাগেজ স্ক্যানিং মেশিনের সামনে বসে আছেন আরেক কর্মকর্তা। স্ক্যানিং মেশিন থেকে ব্যাগেজ বের হওয়ার পরেই শুরু হয় কাস্টমস কর্মকর্তাদের অভিযানসহ বিভিন্ন তালবাহানা। ভারত থেকে নিয়ে আসা শাড়ি, থ্রি, পিছ, কসমেটিক্স, শিশুদের বাইসাইকেল, রিক্সা, হরলিক্সসহ নানা ধরনের প্রশাধনী। তা নিয়ে কাড়াকাড়িসহ মামলার ভয় দেখিয়ে যাত্রীদের হেনস্থ্যা করা হচ্ছে। পরে সর্ব্ব নি¤œ ২’শ টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। কথা হয় হয়রানির সিকার হয়ে বেরিয়া আসা কয়েক পাসপোর্ট যাত্রীর সাথে। প্রথমাবস্থায় বলেন সাংবাদিকদের সাথে বলতে নিষেধ আছে। (নিজের চোখে দেখা কাস্টমস কর্মকর্তাদের ঘুষ বানিজ্যকে বিশ্বাষ করতে কষ্ট হলেও চেকপোস্ট কাস্টমসে স্থাপিত প্রতিদিনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখলে বেরিয়ে আসবে তাদের ঘুষ নেওয়ার অপকৌশলগুলো) সেসাথে যাত্রীদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বাইরে থাকা সাংবাদিকদের কাছে মুখ খোলা না হয়। এছাড়া এখানকার কাস্টমস কর্মকর্তাদের নামে রয়েছে আরো অনেক ঘুষ নেওয়ার সূড়ঙ্গ পথ। যা বর্ণণা করলেন নাম ঠিকানা প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক ল্যাগেজ পার্টি (পাসপোর্টে ভারত থেকে বিভিন্ন মালামাল নিয়ে বাংলাদেশে বিক্রয়কারি)।
ল্যাগেজ পার্টি সুত্রে জানাযায়, বাংলাদেশের মানুষের চাহিদাকৃত বিভিন্ন মালামাল ভারত থেকে কিনে পাসপোর্ট যোগে নিয়ে আসা হয়। পথিমধ্যে বেনাপোল-পেট্রাপোল নোম্যান্সল্যান্ড এলাকায় থাকা বিভিন্ন স্টোরের নামে স্টোর মালিকসহ তাদের নিয়োগকৃত দালালদের মাধ্যমে চেকপোস্ট কাস্টমস ও বিজিবির সাথে কন্ট্রাক্ট করা হয় হয়রানি বন্ধ এবং সরকারি রাজস্ব না দেওয়ার শর্তে। দালালদের মাধ্যমে সর্বনি¤œ ২ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়। মাঝে মধ্যে সাংবাদিকরা উপরি মহলে অভিযোগ করলেও থেমে থাকেনা তাদের ল্যাগেজ ব্যবসা। কোন রকমে ডিউটির ভাগ বাড়িয়ে দিয়ে ব্যাগ-ব্যাগেজের উপরের চেনটা খুলে হাত ঘষা করে ছেড়ে দেওয়া হয়।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে কথা বলেন বেনাপোল নো-ম্যান্সল্যান্ড এলাকার কয়েক স্টোর মালিক। ল্যাগেজ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কাস্টম ও বিজিবি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে মালামাল ছাঢ় করার বিষয়গুলি স্বীকার করেন। বলেন, ল্যাগেজ ব্যসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিজিবি, কাস্টমসসহ অত্র এলাকায় সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকা প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয়। যদি কোন দপ্তরের কর্মকর্তাদের টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করা হয় তাহলে এক পর্যায়ে তা ধরা খেয়ে যায়। পরে সরকারের মোটা টাকার রাজস্ব দিয়ে (ডিএম)’র মাধ্যমে কাস্টমস থেকে ছাঢ় করাতে হয়।
ঘুষের মাত্রা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্টোর মালিকরা বলেন, কয়েকদিন আগে চেকপোস্ট কাস্টমস কর্মকর্তাদের ল্যাগেজ প্রতি ২’শ ৫০ টাকা কওে ঘুষ দেওয়া হতো। এখন তারা ল্যাগেজ প্রতি ৫’শ টাকা দর নির্ধারণ করে ঘুষ নিচ্ছেন। কাস্টমসের ভিতরে থাকা বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের ল্যাগেজ প্রতি ৫০ টাকা থেকে ২’শ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দেওয়া লাগে। কাস্টমস থেকে বের হওয়ার পথে আর্ন্তজাতিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনালের সামনে বিজিবি চেকপোস্টেও জন্য দিতে হয় ল্যাগেজ প্রতি ৫’শ টাকা। সর্বশেষ আমড়াখালী বিজিবি চেকপোস্টে ল্যাগেজ প্রতি ৫’শ টাকা ঘুষ দিতে হয়।
কৌতুহল বসত এক স্টোর মালিকের সাথে যাওয়া হয় বেনাপোল চেকপোস্ট কাস্টমস অভ্যন্তরে থাকা এক গোপন কক্ষে। যেখানে নবাগত এবং কৌশলী পাসপোর্ট যাত্রীদের ডেকে নিয়ে ল্যাগেজ তল্লাশীর নামে মোটা টাকার রাজস্ব {ডিএম}দেওয়ার ভয় দেখিয়ে আদায় করা হয় সর্বনি¤œ ১হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। নিয়ন্ত্রণ করা হয় অপরাধ জগতের সাথে জড়িত স্টোর মালিক তথা দালালদের সাথে ল্যাগেজ প্রতি ৫’শ টাকার হিসাব।
এক পর্যায়ে সাথে থাকা স্টোর মালিক উক্ত কাস্টমস কর্মকর্তাকে বলেন, আমার থেকে ল্যাগেজ প্রতি সাবেকি ২’শ ৫০ টাকা করে নিতে হবে। তিনি বর্তমান দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতির হিসাব দেখিয়ে বলেন, আমরা ৫’শ টাকা না করলে চলব কি করে? যেকোন কারণ বসত তিনি ওই স্টোর মালিকের কাছ থেকে ৩’শ টাকার চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
এদিকে রবিবার বিকাল ৪টার কিছু পূর্বে। কাঁচের ওয়ালে ঘেরা চেকপোস্ট কাস্টমসের বাইরে থেকে দেখা যায় রাজস্ব কর্মকর্তা দাড়িয়ে আছেন গেটের সামনে। পাসপোর্ট যাত্রীরা আসছেন। ল্যাগেজ তল্লাশীর নামে ভয়ভীতি দেখিয়ে কামিয়ে নিচ্ছেন জনপ্রতি ২’শ থেকে ১হাজার টাকা পর্যন্ত। ল্যাগেজ পার্টিরা ইন্সপেক্টর রহিমাসহ তার সঙ্গীয় কর্মকর্তাদের হাতে গোপনীয়তার মাধ্যমে টাকা দিয়ে দৌড়াচ্ছেন আর্ন্তজাতিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনালের মধ্য দিয়ে। বিজিবি চেকপোস্ট পার হয়ে যাচ্ছেন চেক বিহীন। কথা হয় বিজিবি চেকপোস্টের দ্বায়িত্বে থাকা রাকিব’র সাথে। সাধারণ ভদ্রলোকদের ছোট ছোট ব্যাগগুলো চিরুনি অভিযানের মাধ্যমে চেক করা হলেও বড় বড় ল্যাগেজগুলো চেক না করার কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়। তিনি বলেন, কোনটা চেক করব আর কোনটা করব না সেটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে, শেষের দিকে আরো একটা কথা বললেন তিনি। বললেন, যেইটাতে সন্দেহ হয় সেইটা চেক করি।
স্থানীয় সুত্র জানায়, দীর্ঘ দিন ধরে কাস্টমস কর্মকর্তারা পাসপোর্ট যাত্রীদের কাছ থেকে প্রকাশ্যে ঘুষ গ্রহন করে আসছে। পত্রিকায় একটু লেখালেখি হলে মুহুর্তের জন্য তাদের ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ থাকলেও নগদ ঘুষের গন্ধ তাদের পিছু ছাড়েনা। তাই তারা আবারো ঘুষ বাণিজ্যে লিপ্ত হয়ে যায়। এমনি এক বিষয় নিয়ে গত ১২ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে ফিরে আসা বাংলাদেশী পাশপোর্ট যাত্রী মোশারফ হোসেন মিন্টু (যার পাশপোর্ট নং বিই ০৭৫৩৮৮১)‘র কাছ থেকে ল্যাগেজ তল্লাশীর ভয় দেখিয়ে দুই হাজার টাকা ঘুষ গ্রহন করেন চেকপোস্ট কাস্টমস কর্মকর্তারা। পরে উক্ত প্রতিবাদী পাসপোর্ট যাত্রী কাষ্টমস হাউসের কমিশনার শওকাত হোসেনের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। তাতে সত্য প্রমানিত হওয়ায় তিন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়।
এ বিষয়ে কথা হয় বেনাপোল চেকপোস্ট কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা স্বপন কুমার সিং এর সাথে। উপরোক্ত বিষয়গুলি জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি তার অফিসে যেতে বলেন। অপারগতা প্রকাশ করলে তিনি ঘটনার বর্ণণা অস্বীকার করেন।