পুলিশ যদি দ্রুত সংগঠিত হয়ে যেত, আমার কোনো উদ্বেগ থাকত না। তারা যদি সুসংগঠিত হয়ে যায়, বেসামরিক প্রশাসন যদি যথাযথ আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব পালন শুরু করে দেয়, তাহলে আমরাও আশ্বস্ত হতে পারি বলে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ প্রকাশিত হলো:
বর্তমান অবস্থা নিয়ে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের মাঠে থাকতে হচ্ছে। পরিস্থিতি বুঝতে পারছি। দিনের শেষে আমার সেনাদেরই তো মাঠে যেতে হচ্ছে। এর মধ্যেই প্রায় পাঁচ মাস ধরে তারা মাঠে আছেন। যত বেশি আমাদের লোকজন মাঠে থাকবেন, তত বেশি তাদের শৃঙ্খলাবহির্ভূত কাজে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। ডাকাত ধরতে গিয়ে আমার একজন কর্মকর্তা নিহত হলেন। পুলিশ যদি দ্রুত সংগঠিত হয়ে যেত, আমার কোনো উদ্বেগ থাকত না। তারা যদি সুসংগঠিত হয়ে যায়, বেসামরিক প্রশাসন যদি যথাযথ আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব পালন শুরু করে দেয়, তাহলে আমরাও আশ্বস্ত হতে পারি।’
নির্বাচন প্রসঙ্গে জেনারেল ওয়াকার বলেন, দেশবাসী অবশ্যই একটা ভালো নির্বাচন চায়। সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর নির্বাচন চায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান লক্ষ্যও সেটা। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সময়সীমা দিয়েছেন। সেটা ঠিক সময়। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনের রূপরেখা বাস্তবায়নে সব সহযোগিতা করব।
রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, এখন তো আমরা সবাই রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যুক্ত আছি। তারা এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, এই সংস্কার সবার জন্যও দরকার। সংবিধান সংস্কারের বিষয়টি সামনে আসছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা দরকার।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি অত বিস্তারিত যেতে চাই না। আমি সংবিধান বিশেষজ্ঞও নই। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকেই বুঝেছি, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা প্রয়োজন। সশস্ত্র বাহিনীকে রাষ্ট্রপতির অধীনে রাখা যেতে পারে।
সশস্ত্র বাহিনীকে রাষ্ট্রপতির অধীনে রাখার বিষয়ে জেনারেল ওয়াকার বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সশস্ত্র বাহিনী প্রধান উপদেষ্টার অধীনে ছিল। আমি এই ধারণার কথা বলছি। ক্ষমতার ভারসাম্য আনার প্রসঙ্গটি নিয়ে ভাবছি। কীভাবে সেটা হতে পারে, বিশেষজ্ঞরা বললেই ভালো। কিন্তু এই পরিবর্তন আনতে পারলে শাসনব্যবস্থায় একটা ভারসাম্য আসবে।
সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আসার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা আইনশৃঙ্খলার দেখভাল করছি। কিন্তু আমাদের ১/১১–এর অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। সেনাসদস্যদের মাঠে দীর্ঘদিনের উপস্থিতি উচ্ছৃঙ্খল কাজে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি করে। যদিও সংখ্যাটা খুবই কম। শৃঙ্খলাজনিত ঘটনার জন্য আমরা সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত শেষে শাস্তিও দিই। এরপরও শৃঙ্খলাভঙ্গের বিষয়টি আমাদের জন্য বিব্রতকর। আমাদের তো এ ধরনের কাজে যুক্ততা কিংবা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার জন্য তৈরি করা হয়নি। আমরা পুরোপুরি সরকারের পাশে রয়েছি। আমরা চেষ্টা করব প্রধান উপদেষ্টা যেভাবেই আমার বা আমাদের সাহায্য চাইবেন, আমরা সেভাবেই উনাকে সহযোগিতা করব।
অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা প্রসঙ্গে সেনাপ্রধান বলেন, আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা করছি। তারা আমাদের কাছ থেকে যে ধরনের সহায়তা চাইছে, সেভাবেই সহায়তা দিচ্ছি এবং দেব। যে দিন অন্তর্বর্তী সরকার বলবে, ‘আপনাদের অনেক ধন্যবাদ, আপনারা আপনাদের কাজটা সম্পন্ন করেছেন, এখন পুলিশ আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব নেবে।’ আমরা তখন সানন্দে সেনানিবাসে ফিরে যাব।
তিনি আরও বলেন, আমরা পুরোপুরি সরকারের পাশে রয়েছি। আমরা চেষ্টা করব প্রধান উপদেষ্টা যেভাবেই আমার বা আমাদের সাহায্য চাইবেন, আমরা সেভাবেই উনাকে সহযোগিতা করব। এটাতে যদি আমাদের অসুবিধা হয়, সৈনিকদের যদি সাময়িক অসুবিধাও হয়, তারপরও সরকারকে সহযোগিতা করে যাব। দেশ ও জাতির স্বার্থেই আমরা এটা করব। এই জাতির জন্য, দেশের জন্য ও দেশের মানুষের স্বার্থে যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে আমরা তৈরি আছি।
রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার বা পরিবর্তন নিয়ে জেনারেল ওয়াকার বলেন, আমি এটাকে শেষ সুযোগ বলব না। আমি এটাকে সুযোগ হিসেবে বলতে চাই। এই সুযোগ আমাদের কাজে লাগানো উচিত। এটা সবার জন্য ভালো। একটা সুশৃঙ্খল পরিবেশের মধ্যে সবকিছু যদি ঠিক হয়ে যায়, তাহলে দীর্ঘ মেয়াদে অনেকেই তো এই পরিবর্তনের সুফল ভোগ করবেন। রাজনীতিতে বিরোধী দল বিরাট এক সহায়ক শক্তি। সরকার এবং বিরোধী দল একে অন্যের পরিপূরক। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা গুরুত্বপূর্ণ। এমন প্রক্রিয়া থাকলে একে অন্যের ভুল ধরিয়ে দিতে পারে। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকে। সবাই তাদের পরিধির মাঝে থেকে দায়িত্ব পালন করে যেতে পারেন। এটা তো একটা দেশের জন্য খুবই প্রয়োজন।
শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে তিনি বলেন, কিছু কারণ যৌক্তিক আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে উসকানিও আছে।
সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রসঙ্গে সেনাপ্রধান বলেন, আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা তুলনামূলকভাবে পর্যালোচনা করে দেখেছি সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রয়োগের পরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ে যতটা হতাশ মনে হচ্ছে কাউকে কাউকে, এতটা হতাশ আমি না। পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলার বিষয়টি তো একটা সামগ্রিক ব্যাপার। এখানে পুলিশের ভূমিকা রয়েছে, প্রশাসনের আছে, সরকারের ভূমিকা আছে। সেনাবাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। সাধারণ জনগণেরও তো ভূমিকা রয়েছে। সবার সামগ্রিক প্রয়াসের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। এটা আমাদের সবাইকে সব সময় মনে রাখতে হবে। আমরা একজনের ঘাড়ের ওপর দোষ চাপিয়ে বলি সরকার, বলি পুলিশ বা বলি সেনাবাহিনী দায়ী, এটা করা যাবে না। এখানে তো সবার একটা ভূমিকা আছে।
ডিজিএফআই প্রসঙ্গে জেনারেল ওয়াকার বলেন, ডিজিএফআই একটি স্বতন্ত্র সংস্থা। সেনাবাহিনী এ রকম কিছুতে যেতে চায় না, জড়িত হতে চায় না। আমরা এমন কিছু করব না, যাতে সশস্ত্র বাহিনীর সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভারতের ইস্যুতে তিনি বলেন, ভারত আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। আমরা অনেক দিক থেকে ভারতের ওপর নির্ভরশীল। আবার ভারতও আমাদের কাছ থেকে সুবিধাও পাচ্ছে। আনুষ্ঠানিক আর অনানুষ্ঠানিক মিলিয়ে ওদের প্রচুর মানুষ বাংলাদেশে কাজ করছে। এ দেশ থেকে অনেক মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারতে যায়। আমরা তাদের কাছ থেকে অনেক পণ্য কিনছি। কাজেই বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার ব্যাপারে ভারতের বিরাট স্বার্থ আছে। এটা একটা দেওয়া–নেওয়ার সম্পর্ক। ন্যায্যতার ভিত্তিতে হতে হবে এটা। যেকোনো দেশ সব সময় অন্য দেশ থেকে সুবিধা পেতে চাইবে। এটা তো দোষ না। আমি যদি আদায় করে নিতে না পারি, দোষ তো আমারও। এই বিষয়গুলো দেখতে হবে। আমাদের ন্যায্যতার ভিত্তিতে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হবে। জনগণ যেন কোনোভাবেই মনে না করে ভারত বাংলাদেশের ওপর কর্তৃত্ব করছে বা এমন কিছু করছে, যা আমাদের স্বার্থের পরিপন্থী। কোনোভাবেই মানুষ যেন এটা না ভাবে।
তিনি বলেন, আমার কথা হচ্ছে আমার প্রতিবেশীর সঙ্গে আমি এমন কিছু করব না, যেটা তাদের কৌশলগত স্বার্থের পরিপন্থী হয়। একই সঙ্গে আমার দিক থেকে প্রত্যাশা থাকবে যে প্রতিবেশীও আমার সঙ্গে এমন কিছু করবে না, যা আমার স্বার্থের পরিপন্থী। আমি যখন তাদের স্বার্থ দেখব, তারাও আমার স্বার্থটা সমান গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে না। স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে না মিয়ানমার সীমান্তেও। সীমান্তে আমাদের লোকজনকে হত্যা করবে না। আমরা ন্যায্য হিস্যার পানি পাব। এতে তো কোনো অসুবিধা নেই। সম্পর্কটা ন্যায্যতার ভিত্তিতে হোক।
প্রতিরক্ষা সহযোগিতার প্রেক্ষাপটে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। আমাদের এই পররাষ্ট্রনীতি চমৎকার। আমাদের ভারসাম্য রেখে এগিয়ে যেতে হবে। চীন আমাদের উন্নয়নের অংশীদার। বাংলাদেশে তাদের অনেক বিনিয়োগ আছে। কাজেই চীন আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীনের অনেক সমরাস্ত্র আমরা ব্যবহার করছি। বিমানবাহিনী ব্যবহার করছে। নৌবাহিনী ব্যবহার করছে। তাদের সমরাস্ত্র তুলনামূলকভাবে সস্তা।
দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি প্রসঙ্গে সেনাপ্রধান বলেন, বর্তমানে জটিল ও কঠিন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ। এই মুহূর্তে নিজেদের দাবিদাওয়াগুলো আমরা যেন সীমিত রাখি। সরকারকে বিরক্ত না করি। তাহলে সেটা আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সাহায্য করবে। ধৈর্য ধারণ করি। ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তাদের জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত। এটা মুনাফার সময় নয়। চিরাচরিত প্রথার বাইরে গিয়ে কিছু করাটা জরুরি। কারণ, দেশ তো এক কঠিন পথে চলেছে। এ থেকে উত্তরণ পেতে হলে রাজনৈতিক দলকে আসতে দিন। রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে তারা এসব সমস্যার সমাধান করবে। কাজেই আসুন, এ সময় আমরা সবাই মিলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহায়তা করি; যাতে তারা সংস্কারগুলো শেষ করে নির্বাচনের দিকে যেতে পারে। আমরা যেন তাদের ওপর বোঝা না চাপাই। আমরা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতার জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত আছি এবং প্রস্তুত থাকব।