সব ক্যাডারেই আমার লোকজন রয়েছে। বিভিন্ন সময় পুলিশ প্রশাসনসহ অন্যান্য ক্যাডারের বড় কর্মকর্তারা আমার সাহায্য নিয়েছেন। অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিও আমার সাহায্য নিয়েছেন বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারী চাকরির পরীক্ষায়।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গ্রেফতারের পর সিআইডির কর্মকর্তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী। জিজ্ঞাসাবাদকালে তিনি আরো বলেন, আমার ফেসবুক দেখলেই বুঝবেন প্রভাবশালীদের সাথে কেমন সম্পর্ক ছিল। আমি অনেককেই প্রশ্ন দিয়ে সাহায্য করেছি। আবেদ আলীর এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য নিয়ে কাজ করছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা ও সিআইডির কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে গতকাল বুধবার আবেদ আলীর ফেসবুক ঘেটে পুরো তথ্য সংগ্রহ করে একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। এ সময় পুলিশ প্রশাসনসহ প্রভাবশালীদের সাথে তার ঘনিষ্টতা দেখে অনেকটাই অবাক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন দায়িত্বশীল গোয়েন্দা কর্মকর্তা বুধবার ইনকিলাবকে বলেন, আবেদ আলীর সাথে এত প্রভাবশালীদের ছবি আসলেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কেনই বা তাকে ওই কর্মকর্তরা গুরুত্ব দিতেন এবং কেনই বা আবেদ আলী তাদের কাছে যেতেন তা তদন্ত করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের কাজ হচ্ছে আবেদ আলীসহ গ্রেফতারকৃত অন্যান্যদের সাথে যাদের সখ্যতা ছিল এবং প্রশ্ন ফাঁসে যারা তাদের সাথে জড়িত ছিল তা তদন্ত করা। একই সাথে তাদের কাছ থেকে কত তম বিসিএস ব্যাচের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে এবং কারা এর সুবিধা নিয়েছে তা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে অবহিত করা। বিপিএসসির প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় সিআইডি করা মামলায় গত মঙ্গলবার সৈয়দ আবেদ আলীসহ ছয়জন দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। এর পর এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃত ১৭জনকে আদালত কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার পুলিশ সদর দফতরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, আবেদ আলীর সাথে কোন কোন কর্মকর্তার সখ্যতা ছিল তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এরই মধ্যে তার ফেসবুক থেকে সব ধরনের ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব তথ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিক করা হবে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আবেদ আলী জানিয়েছেন, সৈয়দ আবেদ আলী শত শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক। ঢাকায় তার একটি ছয়তলা বাড়ি, তিনটি ফ্ল্যাট ও একটি গাড়ি রয়েছে। গ্রামের বাড়িতে রয়েছে ডুপ্লেক্স ভবন। তবে আবেদ আলীর আরও সম্পদ রয়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, ড্রাইভার আবেদ আলী যদি শত শত কোটি টাকার মালিক হন, তাহলে তিনি পিএসসির যেসব কর্মকর্তার গাড়ি চালিয়েছেন, তারা কত হাজার কোটি টাকার মালিক, তা আর বোঝার অপেক্ষা রাখে না।
সিআইডির একটি দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) প্রশ্নফাঁস নিয়ে বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। গত একযুগে ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িত ছিলেন বিপিএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আর এসব ফাঁস করা প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন অনেকেই। তাদের অনেকে এখন বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরিও করছেন। যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে টাকার বিনিময়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে চাকরি করছেন প্রশ্নফাঁস-কাণ্ডে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসার পর তারাও রয়েছেন আতঙ্কে।
সূত্রের তথ্যে জানা গেছে, ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষায় ১০ জন প্রার্থীর কাছে প্রশ্নফাঁস করে একটি চক্র। তাদের মধ্যে তিনজন বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরি করছেন। এছাড়া আরও কিছু ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নামও রয়েছে আলোচনায়। গত একযুগে ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িত ছিলেন বিপিএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আর এসব ফাঁস করা প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন অনেকেই। তাদের অনেকে এখন বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরিও করছেন। যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে টাকার বিনিময়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে চাকরি করছেন প্রশ্নফাঁস-কাণ্ডে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসার পর তারাও রয়েছেন আতঙ্কে।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, একটি সংঘবদ্ধ চক্র গত ৫ জুলাই পিএসসির অধীনে অনুষ্ঠিত রেলওয়ে সাব এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে। পরে একদল পরীক্ষার্থীর কাছে অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন এবং প্রশ্নের উত্তর বিতরণ করে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে গত ৭ জুলাই ঢাকার শ্যামলী থেকে লিটন সরকারকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। পরে তার দেয়া তথ্যে প্রিয়নাথ ও জাহিদকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে অপর আসামিদের দেয়া তথ্য মতে সিআইডি মোট ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করে। এজাহার নামীয় পলাতক আসামিরা হলেন- পিএসসির সাবেক পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়, মো. শরীফুল ইসলাম, দীপক বণিক, খোরশেদ আলম খোকন, কাজী মো. সুমন, একেএম গোলাম পারভেজ, মেহেদী হাসান খান, গোলাম হামিদুর রহমান, মিজানুর রহমান, আতিকুল ইসলাম, এটিএম মোস্তফা, মাহফুজ কালু, আসলাম, কৌশিক দেবনাথ।
এজাহারে বলা হয়, সংঘবদ্ধ এই চক্রের মূলহোতা সাজেদুল। তিনি বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পিএসসির উপ-পরিচালক আবু জাফরের নিকট হতে সংগ্রহ করতেন। পরে তিনি অন্যান্য সহযোগী সাখাওয়াত ও সাইমের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা হতে চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহ করে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় বাসা ভাড়া বা হোটেলে জড়ো করতেন। পরীক্ষা শুরুর এক-দুই ঘণ্টা আগেই অর্থের বিনিময়ে প্রশ্নপত্র ও উত্তর ফাঁস করতেন। সাজেদুল তার সহযোগীদের মাধ্যমে চাকরিপ্রত্যাশীদের সংগ্রহ করার পাশাপাশি নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে এই চক্রের অন্যতম সদস্য পিএসসির সাবেক চালক সৈয়দ আবেদ আলীর নিকট বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক আয়োজিত বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (বাংলাদেশ রেলওয়ে) সাব এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (নন-ক্যাডার) এর নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন এবং উত্তর বিতরণ করেছেন। সৈয়দ আবেদ আলী আবু সোলেমান মো. সোহেল নামে এক ব্যক্তি বাংলাদেশ কর্ম কমিশনের এই নিয়োগ পরীক্ষার জন্য প্রার্থী সরবরাহ করতো এবং নিজেই বুথ পরিচালনা করতো। সিআইডি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারে, আসামিরা একটি সংঘবদ্ধ চক্র হিসেবে বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন বিসিএসসহ পিএসসির বিভিন্ন গ্রেডের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অর্থের বিনিময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা স্বীকার করে।
ঢাকায় আরেক বাড়ির সন্ধান আবেদ আলীর : প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার আবেদ আলীর ঢাকায় আরেকটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনি দুই যুগ আগে ঢাকার মিরপুরের মধ্য পীরেরবাগে জনতা রোডে একটি ভবনের নিচতলার ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন। পরে সেই বাড়ির পাশে পৌনে চার কাঠার একটি প্লট কিনে সেখানে সাড়ে ছয়তলা ভবন গড়ে তোলেন তিনি। এ নিয়ে ঢাকায় তার দুটি বহুতল ভবন, তিনটি ফ্ল্যাট ও একটি গাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। গ্রামের বাড়িতে রয়েছে ডুপ্লেক্স ভবন। আবেদ আলীর এই বাড়ির পাশের বাড়ির মালিক নজরুল ইসলাম। তিনি জানান, সৈয়দ আবেদ আলী ২০০১ সালে তার ভবনের নিচতলার একটি ফ্ল্যাটে সাড়ে ৪ হাজার টাকায় ভাড়া থাকতেন। প্রথম দিকে সেই ভাড়াও তিনি প্রতি মাসে দিতে পারতেন না। একপর্যায়ে তার বাসায় গভীর রাতে অনেক মানুষের যাতায়াত শুরু হয়। ওই সব লোকজন পরদিন ভোরে চলে যেতেন। এরপর ধীরে ধীরে আবেদ আলীর ভাগ্য বদলাতে থাকে। তিনি ২০১০ সালের দিকে হঠাৎ ৩৫/২ জনতা রোডে পৌনে চার কাঠার প্লট কেনেন। পরের বছর সেখানে সাড়ে ছয়তলার ভবন নির্মাণ করেন। এই বাড়ি করার সময় আবেদ আলী বলেছিলেন, পাইকপাড়ায়ও তিনি ছয়তলা বাড়ি নির্মাণ করছেন।