ইতিহাসের সব থেকে বড় আকারের বাজেট উত্থাপন করেছে সরকার। আর সেদিনই এলো ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণের খবর। চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি। গত ডিসেম্বর প্রান্তিকে ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা, যা আগের তিন মাসের তুলনায় ২৫ দশমিক ১৭ শতাংশ বেশি। বৃহস্পতিবার (৬ জুন) বাংলাদেশ ব্যাংকে থেকে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে ঋণ স্থিতি ছিল ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রথম তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। যেখানে ঋণ বেড়েছে মাত্র ২৩ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোর ৩ লাখ ১২ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা ঋণের ২৭ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। গত ডিসেম্বরে ছিল ১৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর ১২ লাখ ২১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। তিন মাস আগে যা ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ ছিল।
বিদেশি ব্যাংকগুলোর ৬৬ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে খেলাপি ৫ দশমিক ২০ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে ছিল ৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। আর বিশেষায়িত ব্যাংকের ৪০ হাজার ৩২ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ১৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। তিন মাস আগে যা ১২ দশমিক ৮০ শতাংশ ছিল।
এরআগে বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেকটি সূত্র জানায়, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) প্রান্তিকে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫ হাজার ৮৭০ কোটি। তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৫ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। ৩ মাসের ব্যবধানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি বেড়েছে ৩০ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে টাকার অংকে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি জনতা ব্যাংকের। তবে শতাংশের হিসেবে বেসিক ব্যাংক শীর্ষে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ৬৩ শতাংশই খেলাপি। জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে বেসিক ব্যাংকের খেলাপি বেড়েছে ৮৮ কোটি টাকা বা ১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৮ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ২৯২ কোটি টাকা।
গত ডিসেম্বরে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১৭ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩১ শতাংশ। অর্থাৎ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি বেড়েছে ১২ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা বা ৭৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
খেলাপিতে পরের অবস্থানে রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। মার্চ শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৮ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে যা ছিল ১৮ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি বেড়েছে ২ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা বা ১৫ দশমিক ২৯ শতাংশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণে টাকার অংকে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সোনালী ব্যাংক। তিন মাসে ব্যাংকটির খেলাপি বেড়েছে ১ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা বা ১৪ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ১৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের মার্চে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। ব্যাংকটির মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশই খেলাপি।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে রূপালী ব্যাংক। গত মার্চ শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২১ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৭ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা।
চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর মধ্যে খেলাপি কমেছে একমাত্র বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল)। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৯৮২ কোটি টাকা, যা মার্চ শেষে কমে দাঁড়িয়েছে ৮৭৪ কোটি টাকা। সে হিসেবে ব্যাংকটির খেলাপি কমেছে ১০৮ কোটি টাকা বা ১১ শতাংশ। যদিও এই ব্যাংকটিকেই একীভূত করা হচ্ছে সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুশাসনের অভাবে ব্যাংকগুলোর অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের যে অভাব সেটা দিন দিন আরও প্রকট হচ্ছে। যেসব কর্মকাণ্ড আগে ঘটে গেছে তা আস্তে আস্তে বের হয়ে আসছে এবং নতুন নতুন কর্মকাণ্ড ঘটছে। যেহেতু পুরনো অপরাধীদের শাস্তি হচ্ছে না, কাজেই নতুন অপরাধী জন্ম নিচ্ছে। এটা বিভিন্নভাবে আমাদের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ব্যাংকিং খাতটাই ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছে। মানুষ যদিও এখন ভালো ব্যাংকগুলাতে টাকা রাখছে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে এর নেতিবাচক প্রভাব ভালো ব্যাংকগুলোর ওপরও পড়তে পারে। যদি পুরো ব্যাংকিং খাত ধসের মুখে পড়ে তবে ভালো ব্যাংকগুলোও নিরাপদ থাকবে না। তাই এখনই পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ।