২০২১ সালে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পর উপকূলের মানুষ বাঁধ মেরামত করে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলবাসীকে রক্ষায় বাঁধের কোনো বিকল্প নেই। অথচ এই বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দুর্যোগের সময় বেশি কাজে আসে না।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত দেখভালের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)-র পর্যাপ্ত জনবল নেই বলে দুর্যোগের সময় বাঁধগুলোর অকার্যকারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে৷ এবার ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের ১৭ জেলায়ই কম-বেশি বাঁধ ভেঙেছে।
খুলনার কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নে বেড়িবাঁধ ভেঙে ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ এখন পানিবন্দি। ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, “বৃটিশ আমলে বানানো বাঁধ এখন আর আগের মতো নেই, নিচু হয়ে গেছে। প্রস্থও কমে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজনকে খবর দিলেও তারা আসে না। আমরা বার বার অভিযোগ দিয়েছি, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। ”
কপোতাক্ষ নদের তীরের এই জনপদে স্থানীয়রাই বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেননি। রেমালে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন গিয়ে বাঁশ ও মাটি দিয়ে মেরামত করেছিল স্থানীয় লোজকনের সহায়তায়। কিন্তু জোয়ারের পানিতে আজ (বুধবার) সেই বাঁধ আবার ভেঙে গেছে বলে জানান ইউনিয়ন চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, “এখন আমরা জোয়ার এলে তলিয়ে যাই। ভাটায় পানি কিছুটা কমে।”
তার অভিযোগ, “বাঁধ ভেঙে গেলে পাউবোর লোকজন তা বালু ভরাট করে ঠিক করে। কিন্তু বালুর বাঁধ তো টেকে না। দরকার মাটি দিয়ে ভরাট করা। তারা বাঁধের নিচ থেকে বালু তুলে বাঁধে দেয়। আবার ভাঙে, আবার দেয়। পয়সার অপচয় হয়।”
তিনি জানান, ” আগে খুলনা, বাগেরহাট এলাকায় বাঁধ কেটে লবণ পানি ঢুকিয়ে জমিতে চিংড়ি চাষ হতো। সেটা বন্ধ হলেও এখন বাঁধের নিচ দিয়ে পাইপ বসিয়ে লবণ পানি ঢোকানো হয়। আর এর পিছনে আছে প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক নেতার। ফলে পুরো এই জনপদের বাঁধই দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে।”
একই ধরনের অভিযোগ করেন খুলনার দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের বাটাবুনিয়া এলাকার মেম্বার জগদীশ মন্ডল। তিনি বলেন,” আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে আগে থেকেই জানিয়েছি। নিজেরাও বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করেছি, তবু পারিনি। পুরো এলাকার বাঁধই দুর্বল। ফলে একযোগে ১০ জায়গায় বাঁধ ভেঙে যায়।” তার অভিযোগ, “প্রতিবারই জলোচ্ছ্বাসে একই ঘটনা ঘটে। কিন্তু সারা বছর কোনো খবর থাকে না।”
দেশের উপকূলের আরো কয়েকটি জেলায় কথা বলে জানা গেছে কিছু বাঁধ আগে থেকেই দুর্বল ছিল। অনেক জায়গায় আবার বাঁধের অস্তিত্বই নেই। কোথাও আবার বাঁধের ওপর দোকানপাট, ঘর-বাড়ি হয়েছে৷ এই অবস্থা চলছে বছরের পর বছর ধরে। বরগুনার আমতলীর আরপঙ্গাসিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সোহেলী পারভিন মালার অভিযোগ বাঁধ রক্ষার সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজনকে পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, ” আগে খবর দিলেও তারা আসেননি। এই বাঁধ মেরামতের জন্য আমরা অনেক আগেই আবেদন করেছি। কিন্তু মেরামত করা হয়নি। বাঁধ এমনিতেই নিচু, তারপর অনেক জায়গায় বাঁধ বেশ দুর্বল ছিল।”
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, সারা দেশে উপকুলীয় এলাকায় ১৯ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আছে। কিন্তু এই বাঁধের অর্ধেকই ঝঁকিপূর্ণ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের খুলা জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরফুল আলম বলেন, “অধিকাংশ জায়গার বাঁধই ষাটের দশকের। এগুলো দুর্বল। ফলে পানির চাপ বাড়লে ভেঙে যায়। রক্ষণাবেক্ষন করার দায়িত্ব আমাদেরই। কিন্তু সেটা করার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত জনবল এবং অর্থ বরাদ্দ নেই।”
তিনি জানান, ” মানুষও বাঁধের ক্ষতি করছে। অনেকেই বাঁধের নিচ দিয়ে পাইপ বসিয়ে লবণ পানি ঢুকাচ্ছে চিংড়ি চাষের জন্য। আমরা চিহ্নিত করে প্রশাসনকে জানাই ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। আবার বাঁধের ওপর দোকানপাট, ঘর-বাড়ি করেও বাঁধ নষ্ট করা হয়। কিন্তু মানবিক কারণে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না। আবার রাজনৈতিক বিষয়ও থাকে।”
“আমাদের সব বাঁধই মটির বাঁধ। এখন বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নদী শাসন করে কিছু মাটির বাঁধ করা হচ্ছে। সেগুলোকে বলা হয় পোল্ডার। আমরা ব্লক ও জিও ব্যগও ব্যবহার করছি। তবে মূল বাঁধ মাটিরই। এর কোনো বিকল্প আমাদের এখানে নাই।”
আর বরগুনা জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব হোসেন বলেন, “আমরা যখন খবর পাই তখন গিয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করি। আসলে সব সময় খোঁজ নেয়ার মতো জনবল আমাদের নেই।”
বুয়েটের ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্য্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক ড. আনিসুল হক বলেন, ” বাংলাদেশে মাটির বাঁধের কোনো বিকল্প নেই। সমস্যা হচ্ছে রক্ষণাবেক্ষণর। আমাদের এখানে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে যত খরচ করি, সেটা রক্ষণাবেক্ষণে তেমন বরাদ্দ দেয়া হয় না। সেটা যদি হতো, তাহলে এই বাঁধগুলোর এই অবস্থা হতো না।”
“১৯৬০ সালে এই বাঁধগুলো যখন ডিজাইন করা হয়, তখন সেটার উচ্চতা ধরা হয়েছিল ৪.৭ মিটার। আমরা যদি ওই উচ্চতা ধরে রাখতে পারতাম, তাহলে তো আর সমস্যা হতো না। সেটা তো হয়নি। অনেক জায়গায় বাঁধ নিচু হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় অস্তিত্বই নাই। আসল সমস্যা এখানেই,” বলেন তিনি।
তার কথা, ” সিমেন্টের ব্লক ফেলে, বালুর বস্তা ফেলে এর কোনো সমাধান হবে না। ওটা আকস্মিক কোনো সমস্যার সমাধান। মূল সমাধান হলো রক্ষণাবেক্ষণ করে বাঁধগুলোকে তার সঠিক অবস্থানে ফিরিয়ে আনা।”
পানি বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ” অনেকেই মনে করেন, মাটির বাঁধে কী কাজ হবে? তাদের এই চিন্তা ভুল। মাটির বাঁধেই কাজ হবে, যদি বাঁধ ঠিকমতো থাকে। আর আমাদের যে প্রকৃতি, আবহাওয়া, নদী জনসংখ্যা তাতে তো মাটির বাঁধের কোনো বিকল্প নাই। জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পেতে নদীর যে লেভেল, তার চেয়ে উঁচু বাঁধ বানাতে হবে।”
তার কথা, “এই মাটির বাঁধ অ্যামেরিকায়, ক্যানাডায় আছে। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডসে আছে। আমাদের পাশের দেশ ভারতে আছে। তারা এই বাঁধকে ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করছে। আমরা করছি না। স্লুইজ গেটগুলো কে খুলবে কে বন্ধ করবে তার কোনো লোক নেই। এক সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের সারা দেশে ১২ হাজার কর্মচারি ছিল বাঁধ দেখাশোনার জন্য। কিন্তু অর্থের অভাব বলে তাদের চাকরি থেকে বাদ দেয়া হলো। এখন তো এই বাঁধ দেখার কেউ নেই। নতুন প্রকল্প না নিয়ে বরং যে বাঁধ আছে তা রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার।”
” বাঁধ ভাঙার পর ঠিকাদার লাগিয়ে ১০০-২০০ কোটি টাকা একেক এলাকায় খরচ করা হয়। এতে নানা জনের লাভ হয়। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের টাকা নাই। আসলে ওটা না করে এই খাতে বরাদ্দ দিয়ে তা বাঁধ এলাকার মানুষকে নিয়ে কমিটি করে তাদের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা করতে হবে। তাহলে তারাই বাঁধগুলো রক্ষা করবে। উঁচু করবে। কারণ, তারা জানে কখন কী করতে হয়,” বলেন তিনি।
তিনি বলেন, “১৯৯২ সালে বাংলাদেশে সাইক্লোনের পরে মাস্টার প্ল্যানের সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম। তখন আমি কাজ করতে গিয়ে দেখেছি সাধারণ মানুষ সব কিছু জানে। সে জানে সাইক্লোনের সময় কী করতে হবে। যে জানে বাঁধের কোন এলাকা দুর্বল, কেথায় ইদুর গর্ত করেছে, কোথায় দোকানপাট বসিয়ে নষ্ট করা হয়েছে, তাই তাদের দায়িত্ব দিতে হবে।” ডয়চে ভেলে