ফারুক ইফতেখার সুমন, ঈশ্বরগঞ্জ (ময়মনসিংহ) থেকে:
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে বিয়ের দাবীতে গত ৭দিন ধরে প্রেমিকের বাড়িতে অবস্থান নিয়েছে এক প্রেমিকা। বিয়ের প্রলোভেনে ৭বছর ধরে কলেজছাত্রীর বাড়িতে যাতায়াতের পর বিয়ে করতে অস্বীকার করায় সেখানে ছাত্রীটি অনশন শুরু করেছে বলে অভিযোগ তুলেছেন ছেলে পক্ষের লোকজন। ঘটনাটি ঘটেছে উপজেলার ভাটিচরনওপাড়া গ্রামের মৃত জহির উদ্দিন মণ্ডলের বাড়িতে। নানা রকমের ভয়ভীতি দেখিয়েও ছাত্রীটিকে তাড়াতে না পেরে গত মঙ্গলবার রাতে ছেলে পক্ষ থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে।
সরেজমিন উপজেলার রাজিবপুর ইউনিয়নের ভাটিচরনওপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মৃত জহির উদ্দিন মণ্ডলের ছেলে জাহিদ হোসেনের সাথে বিয়ের দাবিতে ওই বাড়িতে অবস্থান করছে ছাত্রীটি। জাহিদের চাচা (বাবার অবর্তমানে অভিভাবক) স্থানীয় ইউপি সদস্য মোজাম্মেল হকের বশত ঘরের একটি কক্ষে ছাত্রীটিকে থাকতে দেয়া হয়েছে। তবে সেই কক্ষের বিদুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। প্রচন্ড গরমের মধ্যে একটি হাত পাখারও ব্যবস্থা রাখা হয়নি। টানা ৭দিন ধরে ওই ঘরে অবস্থান করার পর ছাত্রীটি এখন অসুস্থতাবোধ করছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছে। তার সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০১১ সালের কোন এক সময় মুঠোফোনে রং নাম্বারে তার সাথে জাহিদের প্রথম কথা হয়। সেই থেকে নিয়মিত যোগাযোগে এক সময় দুই জনের মধ্যে গভীর প্রেমের সৃষ্টি হয় এবং বিয়ের আশ্বাস দেন জাহিদ। মেয়ের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত শুরু হয় জাহিদের। চলতি বছরের জানুয়ারীতে বাবা মেয়েটিকে অন্যত্র বিয়ে দিতে চাইলে বিয়েটি ভেঙ্গে দেয় জাহিদ। ১৪ ফ্রেব্রুয়ারীর রাতে মেয়ের বাড়িতে গিয়ে অনৈতিক কাজে লিপ্ত থাকার সন্দেহে জাহিদকে আটক করে এলাকাবাসী। পরের দিন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান (মাইজবাগ ইউনিয়ন) আনোয়ার পারভেজকে নিয়ে মেয়ের বাড়িতে এক সালিশ দরবার বসে। এক পর্যায়ে ওই সালিশ থেকে পালিয়ে যায় জাহিদ। জাহিদ প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য হওয়ায় বিষয়টি তার কর্মস্থলে জানানো হয়। বিপাকে পড়ে জাহিদ। আবার মেয়েটির বাড়িতে যোগাযোগ শুরু করে বিয়ের আশ্বাস দেয়। এবার মেয়েটির পরিবার তাকে বিশ্বাস করতে পারেনি। বিষয়টি নিয়ে ছেলের এলাকার চেয়ারম্যান (রাজিবপুর ইউনিয়ন) মোদাব্বিরুল ইসলামকে জানানো হলে তিনি পুনঃরায় শালিস বৈঠকের আয়োজন করেন। দুই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ওই সালিশ বৈঠকে মেয়েটিকে দুই বছর অপেক্ষা করতে বলে দু’টি কাগজে মেয়ে ও মেয়ের বাবা-মা’র স্বাক্ষর নেয়। কাগজ দু’টির মধ্যে একটিতে চাকুরি বাঁচাতে আপোষ মিমাংসার কথা ও অপরটিতে বিয়ের চুক্তি উল্লেখ করা হয়েছে বলে মেয়েটিকে জানানো হয়। মেয়েটি কাগজ চাইলে উভয় পক্ষের স্বাক্ষরের পর কাগজটি তাদের কাছে দেয়া হবে বলে জানায় চেয়ারম্যানরা। চুক্তির ৬ মাসপরও কাগজ হাতে না পাওয়ায় মেয়েটি গত ৭দিন ধরে জাহিদের বাড়িতে গিয়ে অবস্থান নেয়। এদিকে আপোষ মিমাংসার কথা বলে ছেলে পক্ষের কাছ থেকে দুই চেয়ারম্যান ৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানিয়েছে ছেলের পরিবার। মেয়ের পরিবারকে দেয়ার কথা বলে উক্ত টাকা আনা হলেও মেয়ের পরিবারকে তা দেয়া হয়নি।
জাহিদের চাচা বোরহান উদ্দিন মণ্ডল (৬০) জানান, গত ছয় মাস আগে তাঁর ভাতিজা জাহিদ হোসেন মণ্ডলের (২২) সাথে ওই ছাত্রীর একটা সমস্যা হয়েছিল। জাহিদকে ছাত্রীর বাড়িতে আটকানো হয়েছিল। পরে ঘটনাটি মাইজবাগ ও রাজীবপুর ইউপি চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে এলাকায় সালিশ আয়োজন করে মিটিয়ে ফেলা হয়েছে।
মীমাংসা সম্পর্কে জানতে চাইলে বোরহান মণ্ডল ও তাঁর ছেলে শরিফুল ইসলাম বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে চেয়ারম্যানের কাছে তিন লাখ টাকা ক্ষতিপুরণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। ছেলের আরেক চাচা স্থানীয় ইউপি সদস্য মোজাম্মেল হক এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
ক্ষতিপুরণের বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রী তা অস্বীকার করেন। তিনি ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, কীসের ক্ষতিপূরণ। বিয়ের প্রতিশ্রতি দিয়ে জাহিদ আমার সাথে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। জাহিদ প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য। তিনি (ছাত্রী) এ বিষয়ে তাঁর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন। চাকরি বাঁচানোর জন্যে জাহিদ মণ্ডলের পক্ষের লোকজন তাঁর সাথে লিখিত চুক্তি করে। চুক্তির কোনো অনুলিপি আমাকে দেওয়া হয়নি। ওই চুক্তির কপি দেখিয়ে জাহিদ মণ্ডল চাকরি বাঁচালেও এখন সে আমাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করে দায় এড়াতে চাইছে। তিন লাখ টাকা ক্ষতিপুরণ পাওয়ার বিষয়টি মিথ্যা।
সেই সালিসে উপস্থিত থাকা রাজীবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোদাব্বিরুল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্যে গত মঙ্গলবার দুপুরে ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলেন, টাকা না পেয়ে কেউ কী চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। উভয় পক্ষের সম্মতিতে একটি সালিশ বৈঠকে বিষয়টি মিমাংসা করে দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্যে আরেক সালিসকারী মাইজবাগ ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার পারভেজের খোঁজে মাইজবাগ পরিষদে গেলে তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরিষদের সহায়কের কাজ করেন গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, চেয়ারম্যান সাহেব হয়তো কোনো এলাকায় সালিস দরবারে গেছেন। তবে চেয়ারম্যানের দুটি মুঠোফোন নম্বরে গত বুধবার পর্যন্ত ফোন করে বন্ধ পাওয়া যায়।
ঈশ্বরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ বদরুল আলম খান বলেন, মেয়েটি প্রতারণার শিকার হয়েছে। ছেলে পক্ষের অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই। মেয়েটির পক্ষে কেউ মামলা করলে সেটি আমলে নেয়া হবে। ##