খবর ৭১: ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি ব্যর্থ হলেও শুক্রবার রাজধানীতে বিশাল গণমিছিল করেছে বিএনপি। মিছিলে অংশ নেন হাজার হাজার নেতাকর্মী ও সমর্থক। অনেক দিন পর নগরিতে পৃথক গণমিছিল দু’টিতে যোগ দেন দলের নিষ্ক্রিয় নেতাকর্মীরাও। পদ-পদবি রক্ষায় শোডাউন করে হাজির হন বেশিরভাগ নেতা। ক্ষুব্ধ হাইকমান্ডের কঠোর বার্তায় গণমিছিলে প্রত্যেকে জানান দেন নিজের শক্তিশালী অবস্থান। শুধু মহানগর বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনই নয়, ঢাকাস্থ বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মীরাও অংশ নিয়েছেন গণমিছিলে।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি আয়োজিত গণমিছিল শুরুর আগে বক্তব্যে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘দুটি নতুন দলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। এই দুই দলকে কেউ চেনে না। এদের দিয়ে সরকার নির্বাচন-নির্বাচন খেলা খেলতে চায়। কিন্তু এবার আর এ খেলা খেলতে দেওয়া হবে না। এবারের লড়াই হচ্ছে জীবন মরণ লড়াই। কোন ভয় দিয়ে তাঁদের দমিয়ে রাখা যাবে না।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দেশের ১৮ কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। তাঁরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করবে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ পার পেতে চায়। দেশের জনগণ সেটা হতে দেবে না। শেখ হাসিনার অধীনে কোন নির্বাচন হবে না। এখনো সময় আছে, মানে মানে কেটে পড়ুন, পদত্যাগ করুন– না হলে ফায়সালা হবে রাজপথে। এবারের লড়াই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে লড়াই, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার লড়াই। গণমিছিল শেষে বিএনপি মহাসচিব বলেন, সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আগামী দুদিনের মধ্যে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’
সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনে ১২ দিনের বিরতি দিয়ে রাজধানীতে বিএনপির উদ্যোগে দুটি গণমিছিল হয়। এর মধ্যে একটি মহানগর উত্তরের উদ্যোগে বাড্ডার সুবাস্তু টাওয়ার থেকে মালিবাগের আবুল হোটেলের কাছে এবং অন্যটি মহানগর দক্ষিণের উদ্যোগে কমলাপুর স্টেডিয়ামের কাছ থেকে মালিবাগ রেল গেইট পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বাড্ডার গণমিছিলে এবং দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস দক্ষিণের গণমিছিলে নেতৃত্বে দেন। দুপুরের পর থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে কাঁদা-পানি ডিঙ্গিয়ে বিভিনœ থানা ও ওয়ার্ড থেকে হাজার হাজার নেতা-কর্মী খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে ওই দুই এলাকায় জড়ো হতে থাকেন নেতাকর্মীরা। এসময়ে তাঁরা স্লোগানে মিছিলে পুরো এলাকা প্রকম্পিত করতে থাকেন।
২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি সফল না হওয়ায় দায়িত্বহীনতা ও ব্যর্থতার অভিযোগে ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। একই অভিযোগে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ যুবদলের কমিটি ভেঙ্গে দেওয়ার পর থেকে পুরো দলের মধ্যে বিরাজ করছে আতঙ্ক। কখন কার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেই ভয়ে ভীত দলের বেশিরভাগ নেতা। সেখান থেকে দায়িত্বশীল প্রত্যেক নেতাই এদিন সর্বোচ্চ ভূমিকা নিয়ে কর্মসূচিতে হাজির হন। এর মধ্যে মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক দলের শোডাউন ছিলো চোখে পড়ার মতো। সংগঠনের সভাপতি জহিরউদ্দিন তুহিনের নেতৃত্বে বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডের কয়েক হাজার নেতাকর্মী গণমিছিলে অংশ নেয়। দায়িত্বে অবহেলার জন্য সম্প্রতি কয়েকজনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পরও এসব নেতা পৃথকভাবে শোডাউন করে কর্মসূচিতে হাজির হয়েছেন। ছাত্রদলের সভাপতি অসুস্থতার কারণে উপস্থিত না হলেও তার অনুসারীরা প্ল্যাকার্ড বহন করেছেন এদিন। মহানগর উত্তর যুবদলের সাবেক আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিল্টন এবং সাবেক সদস্য সচিব মোস্তফা জগলুল পাশা পাপেলও ছিলেন গণমিছিলে।
গণমিছিলে ময়মনসিংহ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এএফএম আজিজুল ইসলাম পিকুল এসেছেন বাম পায়ের পুরোটা প্ল্যাস্টার আর হাতে ক্রাচ নিয়ে। তিনি জানান, ২৯ জুলাই ঢাকায় অবস্থান কর্মসূচিতে পুলিশের নির্যাতনে তাঁর পা ভেঙে গেছে। কোনমতে পালিয়ে গ্রেপ্তার এড়াতে পেরেছেন। অসুস্থ হলেও দলের টানে এভাবে তিনি কর্মসূচিতে হাজির হয়েছেন। তাঁর মতো এরকম বিভিন্ন জেলার আরো অনেক নেতাকর্মীকে দেখা গেছে এদিন।
‘রাজপথে গণবিপ্লবে’র হুঁশিয়ারি দিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, তাঁদের এক দফা দাবিকে গগণবিদারি করতে হবে, এটাকে গণভবনে পৌঁছাতে হবে, এটাকে বঙ্গভবনে পৌঁছাতে হবে। দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁরা যে নতুন যুদ্ধ ও নতুন লড়াই শুরু করেছেন– সেই লড়াইয়ে জয়ী হতে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
এ সরকার সংসদ, প্রশাসন, বিচার বিভাগকে ধ্বংস করে দিয়েছে অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল বলেন, সবচেয়ে বেশি ধ্বংস করেছে বিচার বিভাগকে। মানুষের আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে বিরোধী দলের নেতাদের কারাগারে পাঠায়, আটকে দেয়, সাজা দেয়। কিন্তু এসব করে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। যত কারাগারে নিক, যতই নির্যাতন করুক, যতই টিয়ারগ্যাস মারুক, যতই লাঠিচার্জ করুক– গণতন্ত্রের অধিকার আদায় না করে এবার তাঁরা আর ঘরে ফিরে যাবেন না।
বাড্ডা থেকে মালিবাগ আবুল হোটেল পর্যন্ত দীর্ঘ ৪ কিলোমিটারের এ পথে বিকেল ৪টায় গণমিছিলটি শুরু হয়ে আবুল হোটেলের কাছে শেষ হয় বিকাল সাড়ে ৫টায়। মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমানের সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব আমিনুল হকের সঞ্চালনায় সংক্ষিপ্ত সমাবেশে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বক্তব্য রাখেন।
মিছিলে আরো উপস্থিত ছিলেন– দলের ভাইস চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু, কেন্দ্রীয় নেতা জয়নুল আবদিন ফারুক, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, আতাউর রহমান ঢালী, শাহাজাদা সম্রাট, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, শ্যামা ওবায়েদ, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, এবিএম মোশাররফ হোসেন, আজিজুল বারী হেলাল, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, রাকিবুল ইসলাম বকুল, নাজিম উদ্দিন আলম, তাবিথ আউয়াল প্রমুখ।
এদিকে মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালামের সভাপতিত্বে ও ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিনের সঞ্চালনায় কমলাপুরে বীর শ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, এদেশের নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না, হতে দেয়া হবে না– এটা আমাদের সাফ কথা। সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে জনগণ মাঠে সোচ্চার হয়েছে দাবি করে রাজপথেই সরকারের পতন ঘটানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।
এসময়ে আরো বক্তব্য রাখেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এছাড়া দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ দলের ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, জয়নাল আবেদীন, আহমেদ আজম খান, এজেডএম জাহিদ হোসেন, নিতাই রায় চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনিরুল হক চৌধুরী, ফজলুর রহমান, জয়নাল আবেদিন ভিপি জয়নাল, যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন, খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন নবী খান সোহেল, কেন্দ্রীয় নেতা আসাদুজ্জামান রিপন, ফজলুল হক মিলন, নাসির উদ্দিন অসীম, শিরিন সুলতানা, মীর সরাফত আলী সপু, ইশরাক হোসেনসহ কেন্দ্রীয় নেতারা অংশ নেন।
সমাবেশ শেষে গণমিছিলটি মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সবুজবাগ, খিলগাঁও সড়ক দিয়ে মালিবাগ রেল গেইটের সামনে এসে শেষ হয় বিকেল সাড়ে ৬টায়।