খবর ৭১: বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রিত মিয়ানমারের রাখাইন থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এই অঞ্চলের মানবিক সংকট ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের দ্রুত মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের মাধ্যমেই কেবল এ সংকটের টেকসই সমাধান সম্ভব। আশা করি শিগগিরই মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেবে।
মঙ্গলবার ‘ন্যাশনাল কনফারেন্স অন পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ডিপ্লোমেসি প্যানেল ডিসকাশন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁও হোটেলে জনস্বাস্থ্য ও কূটনীতি নিয়ে এ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশে সফলভাবে কোভিড মহামারি মোকাবেলার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মহামারির এই সময়েও বাংলাদেশ প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে আশ্রয় নেওয়া ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে ভুলে যায়নি। তাদের নিয়মিত পরীক্ষা, টিকা ও স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’
‘একথা ভুলে গেলে চলবে না, এদেশে আশ্রিত বিশাল জনগোষ্ঠীটি আমাদের অঞ্চলের জন্য একটি মানবিক ও নিরাপত্তার হুমকি। তাদের নিরাপদ ও সসম্মানে মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়েই কেবল এই সংকটের টেকসই সমাধান নিশ্চিত করা সম্ভব। আমি আশা করি মিয়ানমার খুব দ্রুত তাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।’
দেশের স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে বলতে গিয়ে ‘মা টেলিহেলথ সার্ভিস’ নামে প্রসূতি মায়ের গর্ভকালীন ও প্রসব পরবর্তী সেবা প্রদান করা হচ্ছে বলে জানান সরকারপ্রধান।
বলেন, ‘ডিজিটাল প্ল্যাটফরম সুরক্ষার মাধ্যমে দেশজুড়ে কোভিড ১৯ টিকা ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে। দেশে প্রায় ২৫০টি হেলথ টেক স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্টার্টআপ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ আমরা গ্রহণ করেছি।’
‘অটিজম নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধীদের ঝুঁকি কমাতে আমরা নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ট্রাস্ট গঠন করেছি। এই ট্রাস্টের আওতায় বঙ্গবন্ধু প্রতিবন্ধী সুরক্ষা বিমা চালু করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে সেবা প্রদানের জন্য দেশে ৬৪টি জেলা ও ৩৯টি উপজেলায় মোট ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র পরিচালনা করা হচ্ছে। আরও ২১১টি কেন্দ্র স্থাপনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’
‘মানসিক স্বাস্থ্য আইন ২০১৮’ প্রণয়ন করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা একটি জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনিস্টিটিউট স্থাপন করছি। ৩২টি শ্রম কল্যাণ কেন্দ্রের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছ থেকে শ্রমজীবী মানুষের নিয়মিত চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে। নারী শ্রমিকদের মাতৃত্ব সুরক্ষায় ১২২ দিন অর্থাৎ চার মাসের মজুরিসহ ছুটি ও মাতৃত্বকালীন সুবিধা শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৫০ শয্যার সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল উদ্বোধনের কথা উল্লে করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের স্বাস্থ্য সেবা সম্প্রসারণ ও গুণগত মানোন্নয়নে বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু যা ২০০৬ সালে ছিল ৫৯ বছর, বর্তমানে তা ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। অপেক্ষাকৃত কম খরচে চিকিৎসার মৌলিক চাহিদা পূরণের ধারাবাহিকতায় আমাদের সরকার ইনির্ভাসেল হেলথ নিশ্চিত করতে বদ্ধ পরিকর।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস অতিমারি ছড়িয়ে পড়ার পর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এর অভিঘাত এসে পড়ে। কিন্তু স্বাস্থ্যখাতে আমাদের দীর্ঘদিনের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় এবং সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে আমরা মানুষের প্রাণহানি যেমন কমাতে পেরেছি, তেমনি অর্থনীতি সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি। এবং তার জন্য বিশেষ প্রণোদনা আমরা দিয়েছি।’
বিশেষভাবে কোভিডকালীন সময়ে স্বাস্থ্য সংকট মোকাবেলায় উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় স্বল্পতম সময়ে টিকা ক্রয় ও প্রয়োগের ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশে টিকা পাওয়ার উপযোগী শতভাগ মানুষকে বিনামূল্যে কোভিড ১৯ এর টিকা প্রদান করা হয়েছে। সামগ্রিক ও কোভিড ব্যবস্থাপনা উত্তরণে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যে অন্যতম।’
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘কোভিড মহামারি প্রমাণ করেছে, আমরা যতই নিজেদের পরস্পর বিচ্ছিন্ন ভাবি না কেন, আমাদের সবার ভাগ্য আসলেই একসূত্রে গাঁথা। আমরা কেউই সুরক্ষিত নই যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা সবার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারছি।’
তিনি বলেন, ‘আজ সময় এসেছে টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট ৩ ও অভিষ্ট ১৭ এর আলোকে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত লক্ষ্য অর্জনের কার্যক্রম বৈশ্বিক ও অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করার। এই প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য হবে জনগণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর নিজস্ব স্বক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের কার্যক্রম অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা। এই উদ্দেশ্য পূরণে স্পষ্ট বৈশ্বিক অঙ্গীকারের পাশাপাশি লক্ষ্য অভিমুখী নিবেদিত কূটনৈতিক তৎপরতার কোনো বিকল্প নেই। আর জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার অতীত রেকর্ড কোভিড মহামারি মোকাবেলায় সাম্প্রতিক সাফল্য বিবেচনায় বাংলাদেশ এই প্রচেষ্টা পুরোভাগ থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো মন্ত্রিবর্গ এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে আমি আঞ্চলিক সহযোগিতা সংক্রান্ত পাঁচ দফা সুনিদিষ্ট প্রস্তাবনা উত্থাপন করছি।’
প্রথমত ভবিষ্যৎ জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিকার নিশ্চিত করতে আমাদের সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।’
‘দ্বিতীয়ত নিরাময়যোগ্য সংক্রামক রোগ নির্মূল করতে ক্রমবর্ধমান অসংক্রামক রোগের বিস্তার রোধে বিদ্যমান উত্তম চর্চা বিনিময় আমাদের একত্রে কাজ করতে হবে।’
‘তৃতীয়ত মানসিক স্বাস্থ্যকে জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূলধারায় যুক্ত করতে এবং পানিতে ডুবে যাওয়া বা দুর্ঘটনায় প্রাণঘাতী জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়রোধে আমাদের মনযোগী হতে হবে।’
‘চতুর্থত আমাদের নিজের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও গবেষণা অবকাঠামোর মধ্যে সমন্বয় জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে বেড়ে যাওয়া বিভিন্ন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগের প্রার্দুভাব কমাতে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।’
‘এবং পঞ্চমত মা ও শিশু এবং কিশোর কিশোরীদের স্বাস্থ্যকে টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট ৩ অর্জনের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করে এ অঞ্চলে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা আগামী ৭৫ বছর এবং তারপরেও যেন অর্থপূর্ণভাবে সমগ্র মানবতার সেবা করে যেতে পারে সেই লক্ষ্যে সবাই মিলে কাজ করার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।