খবর৭১ঃ পশ্চিম এশিয়ার পারস্য উপসাগরীয় ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র বাহরাইন। আরবী ‘বাহার’ শব্দের অর্থ সাগর। বাহার থেকে অনুপ্রাণিত নাম বাহরাইন। মূলত সৌদিআরব,কাতার ও ইরানের সাথে দেশটির সমুদ্রসীমা রয়েছে।
আল-জাসরা বাহরাইন থেকে থেকে সৌদি আরবের মূল ভূমি আল-খোবার প্রদেশ পর্যন্ত সাগরের উপর প্রায় ২৫ কিলোমিটার লম্বা কিং ফাহাদ কসওয়ে দ্বারা সংযুক্ত।
দেশটির রাজধানী মানামা, এবং অফিসিয়াল নামঃ, কিংডম অব বাহরাইন। মূল ভাষা আরবী, তবে দেশটির স্থানীয় মানুষজন শিক্ষিত, বন্ধুসুলভ এবং বিনয়ী। ইংরেজী ভাষা প্রচলিত আছে এবং অভিবাসী শ্রমিকদের কল্যাণে অনেকে কিছুটা হিন্দি/বাংলা বুঝেন এবং মাঝেমধ্যে অভিবাসীদের সাথে বলার চেষ্টা করেন। আপনি রেস্তরাঁতে আনমনে কাজ করছেন- হঠাৎ লম্বা সাদা জুব্বা পরা কেউ কিংবা মর্ডান বোরকা পরা রমণী এসে ভাঙ্গা হিন্দি অথবা বাংলায় কথা বলতে চাইছে, ব্যাপারটা খুব হাস্যরসের ও আনন্দমুখর হয়ে ওঠে। তাই মাঝেমধ্যে হ-য-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায়। বাহরাইন রাজতন্ত্র শাসিত দেশ। দেশটি মুসলিম প্রধান হলেও ৭০% শিয়া এবং ২৬% সুন্নি ১% ইহুদি ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষজন বসবাস করেন।
যার ৮ লাখ অভিবাসী এবং ৭ লাখ স্থানীয় মানুষজনের বসবাস। ২.৫ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি আছেন দেশটিতে।
এখানে শিয়া মুসলিমদের সংখ্যা সুন্নীদের দ্বিগুনের বেশি হলেও- সুন্নি মুসলমানেরা সরকার,প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন। এ দেশের সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতা স্বীকৃত। এখানে অনেকগুলো চার্চ,হিন্দু ও ইহুদিদের উপাসনালয় আছে। বাহরাইন আরব বিশ্বে অবস্থিত হলেও- দেশটি অন্যান্য আরব রাষ্ট্র থেকে উদার,অগ্রসর, ফ্ল্যাক্সিবল, অভিবাসীদের প্রতি বন্ধুসূলভ, ব্যক্তি স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং বেশ সোশ্যাল, সিভিলাইজড আধুনিক রাষ্ট্র। এক কথায় দেশটিকে মধ্যেপ্রাচ্যের লাস ভেগাস বলা হয়।
মুদ্রার নামঃ বাহরাইনি দিনার। মুদ্রাবিনিময় সেন্টারে ১ বাহরাইনি দিনার ২৪৮ বাংলাদেশি টাকা মূল্যমান ধরা হয়। নির্মাণ খাতে অধিকাংশ অভিবাসী শ্রমিক গড়ে ১৭০/১৮০ দিনার মাসিক বেতনে এদেশে কাজ করেন। অন্যান্য পেশায় যেমন,রেস্তরাঁ,সেলসম্যান,ফুড ডেলিভারি, ফোরম্যান, সুপারভাইজার পদে ২৫০ থেকে ৩০০ দিনার বেতনে অনেকে কাজ করছেন।
ছোট বড় প্রায় ৩৬ টি দ্বীপ নিয়ে দেশটি গঠিত। অন্যতম প্রসিদ্ধ ও বাঙালি অধ্যুষিত শহরগুলো- মুহার্রাক,রফা’আ, আল-হিদ, ঈসা টাউন,হামাদ টাউন, জিদআলী, মানামা, মালকিয়া, ও জুফায়ার।
বাহরাইনের ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে রয়েছে মাছ, মাংস, ভাত এবং খেজুর। বাহরাইনের সবচেয়ে বিখ্যাত খাবারগুলির মধ্যে একটি হল মাচবুস, যা ভাতের সাথে পরিবেশন করা মাংস বা মাছ দিয়ে তৈরি। আরেকটি পরিচিত খাবার হল মুহাম্মার যা খেজুর বা চিনি দিয়ে পরিবেশিত মিষ্টি ভাত। চিকেন শর্মা, হাল আমলের বার্গার, পিজ্জা,পাস্তা,স্ন্যাক্স জাতীয় খাবার গুলিও সমান জনপ্রিয়। বাহরাইন প্রাচীন কাল থেকেই সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে পরিচিত ছিল। আরব এই উপদ্বীপে ১৯৩২ সালে সর্বপ্রথম তেল আবিষ্কার হয়। এবং পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে বাহরাইন প্রথম তেলভিত্তিক অর্থনীতি গ্রহণ করে। কিন্তু ১৯৮০’র দশকে তেল শেষ হয়ে যায়।
তবে দেশটির আল-হিদ এরিয়া এলুমিনিয়াম সহ বিভিন্ন খনিজ সম্পদে ভরপূর। বাহরাইন আবার তেল উৎপাদন শুরু করেছে এবং সৌদি আরব থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে অপরিশোধিত তেল বাহরাইনে রিফাইন করা হয়।বাহরাইন তার খেজুর গাছের সবুজ বাগানের জন্য বিখ্যাত; প্রাচীন কাল থেকে এটি বাণিজ্যের জন্য একটি সম্ভাবনাময় খাত। এবং ছুটি কাটাতে আশেপাশের রক্ষণশীল দেশগুলো থেকে প্রচুর পর্যটক এখানে আসেন। যা দেশটির অন্যতম আয়ের উৎস।
বাহরাইন একটি প্রাচীন এবং বহু সংস্কৃতির একটি অনন্য ভূমি যা বহু শতাব্দী ধরে বিস্তৃত। আধুনিকীকরণ এবং একটি মিশ্র দৃষ্টিভঙ্গির জাতি সত্ত্বেও, বাহরাইন আজ মূলত একটি আধুনিক আরব সংস্কৃতির দেশ। এখানে ফুটবল উন্মাদনা আমাদের ক্রিকেটের মতো। পক্ষান্তরে অন্যান্য বিনোদন যেমন- বাজপাখি পালন, শিকার ধরা,ঘোড়ায় চড়া, এবং ঘোড়া ও উট দৌড়ের মতো অনেক ঐতিহ্যবাহী রেওয়াজ আছে। সমৃদ্ধির শহর মানামায় ঐতিহ্যবাহী ভিবিন্ন শিল্প ও আধুনিকতার চর্চা সহজে যে কাউকে মুগ্ধ করবে। বাহরাইন জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে: হাতির দাঁতের মূর্তি, মুক্তার গয়না,তামার জিনিসপত্র, সোনার আংটি, এবং বাহরাইনি পূর্বপুরুষদের জীবন যাত্রায় ব্যবহৃত ভিবিন্ন সরঞ্জামাদি।
১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে মধ্য সৌদি আরবের আল খলিফা পরিবার নিজেদের বাহরাইনের শাসক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে। তখন থেকে তাদের বংশধররা দেশটি শাসন করে আসছে। ১৯’শ শতকের চুক্তির জন্য বৃটিশরা দেশটির প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক দেখভালের দ্বায়িত্ব পায়। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশরা নিজেদের চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নিলে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট বাহরাইন নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষনা করে।
বাহরাইনের মোট আয়তন ৭৬৫ বর্গকিলোমিটার বা ২৯৫.৩৭ বর্গমাইল। মূলত পূর্ব সাগর ও পশ্চিম দ্বীপ কিংবা উত্তর সাগর ও দক্ষিণ দ্বীপ কিংবা লবনাক্ত জলের মধ্যবর্তী ভূ-খন্ডটিই বাহরাইন।