মোঃ হাবিবুর রহমান
মহান বিজয় দিবস (ডিসেম্বর. ২০২১) জাতি এমন এক মাহেন্দ্রক্ষণে উৎযাপন করছিলো, যখন ঐ মূহুর্তে মুজিববর্ষের সমাপনী ও বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হচ্ছিলো। যে শিশুটি এ ডিসেম্বর মাসে জন্ম লাভ করেছিলো, সে তখন প াশে উপনীত হয়েছিলো। সেজন্যে তাঁর কাছে চাওয়া পাওয়ার হিসেব করাটা মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে অস্বাভাবিক কিছু নয়। এত দিনে আমাদের অর্জন যেমন অনেক, তেমনি প্রত্যাশার ঘাটতিও কম নয়। আমাদের প্রত্যাশার ঘাটতি থাকলেও সম্ভাবনার অনেক দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। মানুষের মাঝে জ্ঞান ও অর্থের বৈষম্য বৃদ্ধি পাওয়াতে এ ফুটন্ত ফুলটি ক্ষাণিকটা বিচলিত। যে ফুলটাকে বাঁচানোর জন্যে আমাদের পূর্বপুরুষগণ যুদ্ধ করেছিলো। এখন সেটি রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা করাটা আমাদের সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
বাংলাদেশের বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী ২০২১ সালে পালিত হওয়ায় আলাদা গুরুত্ব ছিলো। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে। বাংলাদেশের এ বিজয় অর্জনের পিছনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহচর জাতীয় চার নেতা, বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা, নারী বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষসহ সংশ্লিষ্ট সকলের ভূমিকা ছিলো গুরুত্বপূর্ণ ও অসীম। এ বিজয় ছিনিয়ে আনতে আমাদের সূর্যসন্তান ও মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে। তাদের অবদান আমরা কখনো ভুলবো না।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ৫০ বছর হলেও এ অ লের ইতিহাস শুধুমাত্র প াশ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এ ইতিহাসকে পঞ্চাশের মধ্যে আটকে রাখলে আমাদের অনেক ঐতিহ্য ও ইতিহাস অম্লাণ হয়ে যাবে। সম্প্রতি চ্যানেল ২৪ টিভিতে সলিমুল্লাহ খান ‘৫০ এ বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনায় এ বিষয়টিও তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জাতি সত্তার ইতিহাস শুধু ৫০ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এ অ লের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনেক প্রাচীন। এ সকল ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে আমাদের পূর্বসূরিরা কাজ করলেও বর্তমানে তা বেশি দূর অগ্রসর হয়নি। উদাহরণস্বরূপ নলীনীকান্ত ভট্টোশালী ঢাকা মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা বর্তমানে জাতীয় জাদুঘর নামে পরিচিত। ভট্টোশালী উনিশ শত বিশ এর দশকে ঢাকার দক্ষিণে বিক্রমপুরে প্রায় ৩০টি বড় বড় স্তুপ আবিষ্কার করেছিলেন তারপরেও আর খুব বেশি একটা কাজ হয়নি। এছাড়াও বগুড়ার মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, কুমিল্লার ময়নামতি, ও লালমাই এগুলো আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। যেমন ঢাকার বয়স ৪০০ (চারশত) বছর। ফলত বাংলাদেশ একটি অতি প্রাচীন দেশ এবং এর ইতিহাসও অনেক পুরাতন। সুতরাং ইতিহাস পঠন, চর্চা ও সকল শহীদের অবদান আমাদের স্মরণ রাখা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক ও তরুণ প্রজন্মকে বাংলাদেশের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য চর্চা ও পঠন অব্যাহত রাখতে হবে। দেশের সঠিক ইতিহাস ও স্বাধীনতার দর্শন উপলব্দির মাধ্যমে এ দেশের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন লেখক, কবি, সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার, ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের লিখিত বই পড়ার পাশাপাশি তা নিয়ে গবেষণা করা আমাদের প্রয়োজন। ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে সকলের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত হবে। এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর লিখিত তিনটি বই যথাক্রমে ১ম বই ‘অসমাপ্ত আত্নজীবনী’ (২০১২), ২য় বই ‘কারাগারের রোজনামচা (২০১৭), এবং ৩য় বই ‘আমার দেখা নয়াচীন (২০২০)’ বইগুলো অধ্যয়ন ও তা অনুশীলন করার মাধ্যমে দেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
মহান বিজয় দিবসের এক সুদীর্ঘ ও আবেগঘন ইতিহাস রয়েছে। যে সকল সংগ্রাম ও আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এ অ লের মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে উজ্জীবিত হয়েছিলো, সে সকল আন্দোলন আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ সকল সংগ্রামের মধ্যে অন্যতম হলো যথাক্রমে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। এ সকল আন্দোলন ও সংগ্রাম থেকে আমাদের শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে এবং দেশের কল্যাণে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর অবদান অপরিসীম। তিনি ছাত্র অবস্থা থেকেই অত্যাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্ছার ছিলেন। উপর্যুক্ত আন্দোলন ও সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ছিলো অতুলনীয় এবং পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর জন্যে হুমকি স্বরূপ। ২০২১ সালের বিজয় দিবসে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশবাসিকে যে শপথবাক্য পাঠ করিয়েছিলেন তাতে দেশপ্রেম এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, “শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না। দেশকে ভালোবাসবো। দেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করবো। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে উন্নত সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সোনার বাংলা গড়ে তুলবো। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের সহায় হোন।” সুতরাং বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যে আমাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করার পাশাপাশি স্বাধীনতার স্পৃহা ধারণ করতে হবে।
বিজয় লাভের পর থেকেই বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করেছে। নারীর ক্ষমতায়ন, মানবিক সহায়তা কার্যক্রম, উন্নয়ন ক্ষেত্র এবং জলবায়ুর সাথে অভিযোজন কৌশলে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের জন্যে ‘রোল মডেল’ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। যদিও উপর্যুক্ত ক্ষেত্রে আমাদের কিছু চ্যালেঞ্জ ও হুমকি রয়ে গেছে। তাই আমাদের আত্নতুষ্টিতে থাকলে হবে না। বরং দেশ ও জাতির সমৃদ্ধির জন্যে অন্যান্য রাষ্ট্রের ভাল দিকগুলো বিবেচনা করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। সাধারণ নাগরিক হিসেবে দেশের প্রতি আমাদের অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। প্রথমত, নাগরিক হিসেবে যে সকল দায়িত্ব রয়েছে, তা সুসম্পন্নভাবে পালন করা। তরুণ প্রজন্ম এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ করা। যথাসম্ভব দেশীয় পণ্য উৎপাদন এবং তা ক্রয়ে অন্যকে উৎসাহিত করা। তরুণ প্রজন্ম এবং দেশের নাগরিকদের দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানার পাশাপাশি তা মনে প্রাণে ধারণের মাধ্যমে এ দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব বলে বিশ^াস করি।
যে কোন দিবস উৎযাপন ও পালন করা আমাদের জন্যে অত্যন্ত সম্মান ও আনন্দের। কিন্তু কিছু কিছু স্থানে এ আনন্দ ও উৎল্লাস বিষাদে পরিণত হয়। পত্র-পত্রিকায় এ বিষয়গুলো পরিলক্ষিত হয়েছে যে, পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, শ্রদ্ধা নিবেদনকে কেন্দ্র করে মারামারি, ও ছিনতাই ইত্যাদি নেতিবাচক ঘটনা ঘটে যা মোটেই কাম্য নয়। এরূপ সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, এ দেশকে আমরা সবাই মিলে শত্রুপক্ষের সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। সঠিক ইতিহাস চর্চা, ও বৈষম্য রোধ করতে পারলেই উপর্যুক্ত সমস্যা সমাধান সম্ভব। বিজয় দিবসে লাল সবুজ পরিধানের পাশাপাশি কাজে কর্মে সে দর্শনের প্রতিফলন থাকতে হবে। দেশপ্রেম ও নাগরিক দায়িত্ব পালন করলেই দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়া সম্ভব।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উচ্চারিত ‘আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ এখনো চলমান রয়েছে। সম্প্রতি অধ্যাপক রেহমান সোবহান Bangabandhu’s vision for a Just Society: Promises Kept and Promises to Keep শীর্ষক বক্তব্যে বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর রূপকল্প ও মুক্তির সংগ্রামের অন্তর্নিহত তাৎপর্য অনুধাবন করে সামনে এগোতে হবে। আয়ের পার্থক্য ও সামাজিক বৈষম্য হ্রাস করার মাধ্যমে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ভিশন প্রতিফলিত হবে। মানসম্মত শিক্ষা, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসহায়তা প্রদান, এবং গণতন্ত্র ও শাসনের প্রাতিষ্ঠানীকরণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে উঠবে।
আমরা যদি আমাদের জনশক্তিকে মানব সম্পদে রূপান্তরিত করতে পারি তাহলে বেকারত্বের হার কমার পাশাপাশি দেশটাকে সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলা সম্ভব। এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, পৃথিবীতে সম্পদ অসীম নয়। সুতরাং আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ও অন্যান্য সম্পদের যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জসমূহকে মোকাবেলা করে তার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের তরুণ প্রজন্মের উপর মুক্তিযোদ্ধা ও এ অ লের সকল শহীদের প্রত্যাশা অনেক। সতুরাং তা পূরণ করার জন্যে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকরণ, গবেষণার উপর জোরদান ও উদ্ভাবনী চিন্তার মাধ্যমে জাতি অভিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাক, এটাই সবার প্রত্যাশা।
২০২১ সালে বিশ^ব্যাপী অনেক বিস্ময়কর ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন দেশের শাসন ক্ষমতার পালাবদলে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ হয়েছে যেমন মিয়ানমার, মালি, তিউনেসিয়া, এবং সুদানে সেনাবিদ্রোহ হয়েছিলো। এছাড়াও বিখ্যাত অনেক ব্যক্তিকে আমরা হারিয়েছি। যুক্তরাজ্যের যুবরাজ পিলিপ, বলিউডের দিলিপ কুমার, দক্ষিণ আফ্রিকার এফডব্লিউ ডি ক্লার্ক, এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী আইকন আর্কবিশপ ডেসমন্ড টুটু প্রমূখ এ ধরণী থেকে বিদায় নিয়েছেন। বাংলাদেশেও অনেক গুণীজনকে আমরা হারিয়েছি। অন্যদিকে বিশে^র দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ব্যবসা- বাণিজ্য ও ভূ-রাজনীতি নিয়ে টানটান উত্তেজনা বিরাজমান ছিল। এশিয়ায় বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে তালিবান কর্তৃক আফগানিস্তানের ক্ষমতা আরোহন ছিলো অন্যতম।
খ্রিষ্টীয় ২০২২ সালে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। এ বছর সকলের জীবনটা গড়ে উঠুক অনেক সমৃদ্ধিময় ও প্রাণবন্ত। এ বছরের যেমন সম্ভাবনা রয়েছে তেমনি অনেক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ২০২২ সালে ওমিক্রন, ধনবৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন, ইত্যাদি বিষয়ের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলা করে পৃথিবী এগিয়ে যাবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। বৈশি^ক পরিমণ্ডলে পরাশক্তির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বিরাজ করুক এবং জাতিসংঘ শক্তিশালী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে বলে আশা করি। উন্নত, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত রাষ্ট্রের মধ্যে যে বৈষম্য রয়েছে তা হ্রাস পাবে বলে প্রত্যাশা করছি। মানুষ মানুষের প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিলে আমাদের অনেক সমস্যা এমনিতেই সমাধান হয়ে যাবে। ২০২২ হোক সকল মেহনতী ও সাধারণ মানুষের। স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ধারণ করে বাংলাদেশ বিশ^ পরিমণ্ডলে মাথা উচু করে দাড়াবে এই প্রত্যাশা করছি।
লেখক,
মোঃ হাবিবুর রহমান
গবেষক ও কলামিষ্ট
ই-মেইল: mirmohammadhabib@gmail.com