ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি: বাংলাদেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে এক সময় নীলগাইয়ের অবাধ বিচরণ ছিল। কিন্তু বনাঞ্চল উজাড় হওয়ায় ও শিকারের কারণে এদের সংখ্যা দিন
দিন কমতে থাকে। এ বন্যপ্রাণীটি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। তবে বিরল প্রজাতির এ নীলগাইয়ের দেখা মিলছে ঠাকুরগাঁওয়ে। একটি দুটি নয় এ পর্যন্ত চারটি নীলগাই উদ্ধার হয়েছে এ জেলা থেকে।
বেশ কয়েক বছর ধরে প্রতিবেশী ভারত থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে নীলগাই ঢুকে পড়ে সীমান্তের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে। স্থানীয় গ্রামবাসী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই নীলগাই আটক করে বংশবৃদ্ধির জন্য নিয়ে যায় দিনাজপুরের রামসাগর উদ্যানের মিনি চিড়িয়াখানায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৪০ সালের পর ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রানীশংকৈলের যদুয়ার গ্রামের পাশে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে বয়ে যাওয়া কুলিক নদের ধারে একটি মাদি নীলগাই দেখতে পান স্থানীয় জেলেরা। গ্রামবাসী মিলে নীলগাইটিকে আটক করেন। পরদিন বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এটিকে
উদ্ধার করে দিনাজপুর রামসাগর জাতীয় উদ্যানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চার দিন থাকার পর সেই নীলগাই মৃত বাচ্চা প্রসব করে। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে ১৮ মার্চ উদ্যানটির বেড়ার সঙ্গে ধাক্কা লেগে স্ত্রী নীলগাইটি মারা যায়। এরপর ২০২১ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকার নাগর নদী তীরে একটি কালো রঙ্গের পুরুষ নীলগাই আটক করে স্থানীয়রা। পরে নীলগাইটি বন বিভাগ ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। একই বছরের জুলাই মাসে রানীশংকৈল উপজেলার ধর্মগড় সীমান্ত এলাকার
কাঁটাতার পেরিয়ে একটি ধূসর রঙের পুরুষ প্রজাতির নীলগাই ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বিলুপ্তপ্রায় এই প্রাণীটি দেখে ধরার চেষ্টা করে গ্রামবাসীরা। স্থানীয়দের ধাওয়া খেয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মাটিতে পড়ে গিয়ে
ঘটনাস্থলে প্রাণ হারায়। সম্প্রতি আবারও হরিপুর উপজেলার মিনাপুর গ্রামে ধরা পড়ে একটি পুরুষ
নীলগাই। তবে ভারত সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় কাঁটাতারের খোঁচায় প্রাণীটির শরীর মারাত্মক জখম হয়। পরে স্থানীয় বিজিবি সদস্যরা আহত অবস্থায় উদ্ধার করে নিজেদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পুরুষ নীলগাইটির মৃত্যু হয়।
নীলগাইয়ের বিষয়ে জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ ‘নীলগাই একটি সময় এ দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলে দেখা যেত। ধীরে ধীরে বনভূমি উজাড় ও শিকারিদের হাতে মারা পড়ার কারণে বিলুপ্তির মুখে পড়ে এই হরিণবিশেষ প্রাণীটি। বর্তমানে ভারতসহ অন্যান্য রাষ্ট্র এই প্রাণীকে গৃহপালিত পশু
হিসেবে লালন পালন করে থাকে।’ আমাদের দেশে জনসাধারণ জন্য এ প্রাণীটি লালন পালন সরকারিভাবে নিষিদ্ধ রয়েছে। যার কারণে প্রাণীটি প্রজনন ও বংশ বিস্তারের উদ্যোগ নেয়নি প্রাণী
সম্পদ বিভাগ। এটি দুগ্ধজাতীয় পশু না হলেও এর মাংস খেতে হরিণের মতোই। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রাণীটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হলে দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখতে পারে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
বিলুপ্ত এই প্রাণীগুলো সম্প্রতি ভারত হয়ে বাংলাদেশে ছুটে আসার কারণ কি এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মাজেদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘নীলগাই একটি তৃণভোজী প্রাণী। বেঁচে থাকার তাগিদে এরা ঘাস, লতাপাতা, গুল্ম ও বিভিন্ন ফসলের শস্যদানা খেয়ে জীবন ধারণ করে।
বন জঙ্গল উজাড় হয়ে যাওয়ার কারণে এ প্রাণীগুলো লোকালয়ে এসে মানুষের ফসলের শস্যদানা খেয়ে ফেলছে। প্রাণীটির হাত থেকে ফসল রক্ষার্থে সম্প্রতি ভারতের অধিকাংশ এলাকায় এ প্রাণীটিকে হত্যা ও শিকার করা হচ্ছে। যার কারণে ভয়ে ও নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেতে বর্ডার ক্রস করে এরা বাংলাদেশে চলে আসছে। তবে
বাংলাদেশে যেহেতু প্রাণীটি দেখা পাওয়া যায় না তাই মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করে। তবে প্রাণীটি ক্ষতিকর নয়। এটি হরিণের মতোই নিরীহ একটি প্রাণী। যেহেতু আমাদের দেশ থেকে এ নীলগাইটি বিলুপ্ত তাই এটিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রাণীটি যে বর্ডার পার হয়ে এ দেশে ঢুকে পড়ছে ওই
এলাকা গুলো চিহ্নিত করে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। যেন প্রাণীগুলো নিরাপদে এই দেশে আসতে পারে।’
মো. মাজেদ জাহাঙ্গীর আরও বলেন, ‘একটি স্ত্রী নীলগাই দুই বছরের মধ্যে
সন্তান দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করলেও পুরুষ নীলগাইয়ের সময় লাগে তিন বছর। তবে
প্রজননক্রিয়ার জন্য এরা চার বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করে। প্রাণীটির গড় আয়ু
২১-২২ বছরের মতো হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Boselaphus Tragocamelus। ১০০
বছরের ও আগে নেপাল, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় নীলগাই
দেখা যেত। ওই সময়ে ঠাকুরগাঁওসহ দিনাজপুর, পঞ্চগড়, জয়পুরহাট ও নীলফামারীর
মাঠে-ঘাটে নীলগাইয়ের বিচরণ ছিল চোখে পড়ার মতো।’