অর্থনীতির সব সূচকে বড় ধাক্কা

0
235

খবর৭১ঃ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে ‘ভর্তুকি’ ছাড়া অর্থনীতির সব সূচকে বড় ধরনের ধাক্কা আসছে। ইতোমধ্যেই কিছু সূচকে নেতিবাচক অবস্থা দেখা দিয়েছে। আগামীতে এর প্রভাব আরও স্পষ্ট হবে। এরই মধ্যে অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে। শিল্পপণ্যের দামও বাড়বে। বেড়ে গেছে গণপরিবহণসহ সব ধরনের পরিবহণ ব্যয়।

এতে ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে মূল্যস্ফীতির হার। কমে যাচ্ছে টাকার মান। বেড়ে গেছে জীবনযাত্রার ব্যয়। যাদের আয় বাড়বে না তাদেরও এখন বাধ্য হয়ে কমাতে হবে জীবনযাত্রার মান। ফলে নতুন করে আরও কিছু মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাবে-এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

সূত্র জানায়, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে এ খাতে সরকারের ভর্তুকি দেওয়া লাগছে না। এতে সরকারের বাড়তি ঋণের বোঝা বইতে হবে না। কিন্তু তেলের কারণে অন্যান্য খাতে ভর্তুকির মাত্রা বাড়াতে হবে। ফলে সরকারের ঋণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই অবস্থায় সরকার যে লক্ষ্য নিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সে লক্ষ্য অর্জিত তো হচ্ছেই না, উলটো জনঅসন্তোষ বাড়ছে, ভোগ্যপণ্য ও সেবার বাজারে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।

বিপিসির (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) তথ্য অনুযায়ী দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সমন্বয় করা হলেও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এখনো বাড়তি দরেই কিনতে হচ্ছে তেল। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। এতে অতিরিক্ত বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে আমদানি করতে হচ্ছে সবকিছু। যার প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় চাপ বেড়ে গেছে।

এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের মূল্য আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে এ খাতে ভর্তুকি দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন দেশের শীর্ষ স্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, সরাসরি জ্বালানি তেলে ভর্তুকি না দিয়ে তেলের দাম বাড়ানোর ফলে এখন সব খাতে সেবা ও পণ্যের দাম বেড়ে চলছে। এতে জন অষন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে। এখন হয় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে নয়তো ভর্তুকি আরও বাড়াতে হবে।

বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম প্রায় ৫০০ শতাংশ বেড়েছে। এ খাতেও হয় ভর্তুকি বাড়াতে হবে, নয়তো দাম বাড়াতে হবে। স্থানীয় বাজারে এগুলোর দাম বাড়ানো হলে পণ্য ও সেবার দাম আরও বাড়বে। তখন কৃষিসহ অন্যান্য খাতে ভর্তুকি আরও বাড়াতে হবে।

৩ নভেম্বর রাতে হঠাৎ করে সরকার ডিজেলের মূল্য প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করেছে। বৃদ্ধির হার ২৩ দশমিক ৮ শতাংশ। এর প্রভাবে গণপরিবহণ ভাড়া সরকার বাড়িয়েছে ২৬ শতাংশ। কিন্তু বাস মালিকরা বাড়িয়েছেন ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ।

ট্রাক, কার্ভার্ড ভ্যানে ভাড়া বেড়েছে ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ। এসব নিয়ে পরিবহণ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা চলছে। মাছ, মাংস, শাকসবজিসহ প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে গড়ে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ। শিল্প পণ্যের দাম এখনও বাড়েনি।

তবে তাদের উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে আগামীতে এসব পণ্যের দামও বাড়বে। এর সঙ্গে সমন্বয় রেখে প্রায় সব খাতেই পণ্য ও সেবার দাম বাড়বে। পণ্য ও সেবার দাম বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে) মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এ হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু পণ্য, সেবার মূল্য যেভাবে বাড়ছে, একই সঙ্গে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে তাতে চলতি বছরে এ হার লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাখা সম্ভব না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। কেননা আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

জুলাইয়ে ছিল ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এ হার এখন ঊর্ধ্বমুখী। জুলাইয়ের তুলনায় প্রতি মাসেই সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। নভেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে এ ধাপে আরও বেড়েছে পণ্য ও সেবার মূল্য। আগামীতে মূল্যস্ফীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, জ্বালানি এমন একটা পণ্য যার মূল্য বাড়লে মূলত সবকিছুর দামই বেড়ে যায়। এর প্রভাবে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বাড়বে। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় ও বিপণন খরচ বেড়ে যাবে। বাড়তি দামে পণ্য উৎপাদন করে আবার বাড়তি দামেই বিক্রি করতে না পারলে উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তখন তারা উৎপাদন কমিয়ে দেবেন। তাতে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ সংকট দেখা দেবে। এতে বাজার অস্থির হয়ে উঠবে।

জানতে চাইলে পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোতে সব কিছুর দাম বাড়বে। এতে নতুন করে আরও কিছু মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাবে। যারা দরিদ্র ছিল তারা যাবে অতি দরিদ্রের সীমায়। মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রার মানে আপস করতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় আগস্টে আমদানি ব্যয় ৭৩ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে বেড়েছে ৫০ দশমিক ৫৬ শতাংশ। অক্টোবরেও এ হার ঊর্ধ্বমুখী। গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে আমদানি ব্যয় কমেছিল সাড়ে ১১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ৪৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের ওই সময়ে এলসি খোলা বেড়েছে ৪৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এসব পণ্য আগামী ১ থেকে ৪ মাসের মধ্যে দেশে আসবে। ফলে আগামীতেও আমদানি ব্যয় আরও বাড়বে।

আমদানি ব্যয় বাড়ার বিপরীতে রপ্তানি আয় বাড়লেও রেমিট্যান্স কমছে। দেশের রপ্তানি আয় দিয়ে আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হয় না। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি হচ্ছে। প্রতি বছরই এই ঘাটতি বাড়ছে। এ ঘাটতি মেটানো হয় রেমিট্যান্স দিয়ে। এখন রেমিট্যান্স কমায় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় অস্থিরতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ২২ দশমিক ৬২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ১ শতাংশেরও কম।

অক্টোবরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৬০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে কমেছিল ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ার কারণে আগামীতে রপ্তানি বাড়তে পারে। অক্টোবরে রেমিট্যান্স কমেছে ২১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে বেড়েছিল ২৮ শতাংশের বেশি। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে রেমিট্যান্স বেড়েছিল ৪৩ দশমিক ০৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কমেছে শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here