রোহিঙ্গাদের অধিকার উপেক্ষা করছে বিশ্বব্যাংক

0
322

খবর৭১ঃ

বিশ্বব্যাংকের ‘রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক’ সংক্রান্ত প্রস্তাবের জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ করছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। পররাষ্ট্র ছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয় মত না দেওয়ায় ইআরডি শেষ দিন পর্যন্ত কোনো জবাব দেয়নি। উলটো তারা সংস্থাটির কাছে ১০ দিন সময় চেয়েছে। ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জবাব দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল।

এই ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় ঋণ সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দেয় বিশ্বব্যাংক। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ দেশের সুশীল সমাজ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করছেন। তারা বলেন, উন্নয়ন সহযোগীর এ প্রস্তাবে সায় দিলে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো কঠিন হবে। এছাড়া বিশ্বব্যাংক রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার অস্বীকার করছে। কারণ সম্মানজনকভাবে মিয়ানমারে ফেরত যাওয়াটাই হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার। নতুন প্রস্তাবে সমর্থন দিলে তাদের সেই অধিকার ব্যাহত হবে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরর অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বিশ্বব্যাংকের এ ধরনের প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন দেওয়া কখনো উচিত নয়। কেননা রোহিঙ্গা নিয়ে সলিউশন হচ্ছে তাদের নিরাপত্তার সঙ্গে মিয়ামনারে ফেরত পাঠানো। তাই এ ধরনের প্রস্তাব মেনে না নিয়ে বরং রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারকে চাপ সৃষ্টি করা উচিত। এ অবস্থানেই বাংলাদেশকে অটল থাকতে হবে।

শনিবার ছিল বিশ্বব্যাংকের কাছে জবাব পাঠানোর শেষ দিন। এদিন ইআরডির অতিরিক্ত সচিব ও বিশ্বব্যাংক উইংয়ের প্রধান আব্দুল বাকী জানান, পলিসি ব্রিফটি শুধু বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। এটা বিশ্বব্যাপী যেখানে উদ্বাস্তু রয়েছে সেসব দেশের জন্য প্রযোজ্য। এ বিষয়ে সংস্থাটি বাংলাদেশের মতামত জানতে চেয়েছে। আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাছে মতামত জানতে চেয়েছি। এখন পর্যন্ত শুধু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই মতামত পাঠিয়েছে। অন্যদের মতামত পেলে ইআরডি থেকে বিশ্বব্যাংকের কাছে মতামত পাঠানো হবে। তবে এই পলিসি ব্রিফের বেশকিছু বিষয়ের সঙ্গে আমরা আগেও একমত ছিলাম না, এখনো একমত নই। সেদিক থেকে নেতিবাচক মতামতই যাবে। এখন অপেক্ষা করা হচ্ছে অন্যান্য মন্ত্রণালয়গুলোর মতামতের জন্য। এজন্য ১০ দিন সময় চাওয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংকের কাছে।

সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে ‘রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক’ শীর্ষক একটি পলিসি পেপার পাঠানো হয় ইআরডির কাছে। এতে বলা হয়েছে-উদ্বাস্তুদের সমাজে অন্তর্ভুক্ত করা যায় কিনা। এছাড়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে-৩১ জুলাইয়ের মধ্যে কোনো মতামত না পেলে ওই প্রস্তাব সরকার মেনে নিয়েছে বলে তারা ধরে নেবে। বিশ্বব্যাংকের এই রিফিউজি পলিসি রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য দেশে অবস্থিত সব উদ্বাস্তুর জন্য প্রযোজ্য। এটি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়। বৈশ্বিক ভিত্তিতে তৈরি ফ্রেমওয়ার্কের তিনটি উদ্দেশ্য হচ্ছে-উদ্বাস্তু ও হোস্ট কমিউনিটির জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করা, উদ্বাস্তুরা যে দেশে অবস্থান করছে সেই সমাজে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া অথবা তাদের ফেরত পাঠানো এবং দেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা যাতে করে নতুন উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হয়। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্কের পক্ষে মত দিলে রোহিঙ্গারা যে কোনো স্থানে চলাচল করতে পারবে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অর্থাৎ শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে পারবে বা ব্যবসা করতে পারবে। পাশাপাশি তাদের নিবন্ধনের আওতায় এনে সামাজিক পরিচয়পত্রও দিতে হতে পারে। ইতোমধ্যেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিশ্বব্যাংকের এ প্রস্তাব মেনে নিয়ে তাদের ঋণ গ্রহণ করলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বদলে তাদের বাংলাদেশেই চিরতরে রেখে দিতে হতে পারে। এজন্য ওই প্রস্তাবের পরিবর্তন না হলে উদ্বাস্তু সংক্রান্ত কোনো অর্থ সংস্থাটির কাছ থেকে নেওয়া যাবে না।

এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, ২০০২ সালে যখন কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ছিল। তখন প্রায় ১৯-২০ হাজার রোহিঙ্গাকে এ দেশে অবাধ চলাচলের পক্ষে ইউএনএইচসিআর থেকে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সে সময় আমরা সেটি প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। এখন বিশ্বব্যাংকও যদি ওই ধরনের প্রস্তাব দেয় তাহলে সেটি মেনে নেওয়া ঠিক হবে না, প্রত্যাখ্যান করতে হবে। ইতোমধ্যেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে কথা বলেছেন, আমি তার সঙ্গে সম্পূর্র্ণ একমত। তাদের এ রকম সুবিধা দিলে একদিকে এ দেশে এমনিতেই কর্মসংস্থানের সুযোগ কম, তার ওপর রোহিঙ্গাদের কাজ করতে দিলে কি অবস্থা দাঁড়াবে। এছাড়া যারা এখনো মিয়ানমারে আছেন তারাও এ দেশে আসতে উৎসাহী হবেন। আমাদের লক্ষ্য তাদের এ খাতে অন্তর্ভুক্ত করা নয়। তাদের সম্মানজনক ফেরত পাঠানো। আমরা তাদের বন্দি শিবিরে রাখিনি, তাদের আশ্রয় দিয়েছি। অস্থায়ীভাবে তাদের উন্নত জীবনযাপনের জন্য সরকার ভাসানচরে ব্যবস্থা করছে। সেখানে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা দেওয়া উচিত।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিশ্বব্যাংক এবং জাতিসংঘসহ অন্য সংস্থাগুলো জটিল সমস্যার সহজ সমাধান হিসেবে এ ধরনের প্রস্তাব দিচ্ছে। কিন্তু এই সহজ সমাধানের ভেতরে যে আরও জটিলতা হবে সেটি তারা অনুধাবন করতে পারছে না। সম্মানজনকভাবে মিয়ানমারে ফেরত যাওয়াটাই হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবে তাদের মৌলিক অধিকার অস্বীকার করা হচ্ছে। এছাড়া এ ধরনের প্রস্তাব মেনে নিলে আন্তর্জাতিকভাবে এবং মিয়ানমারের সঙ্গে যে দরকষাকষি চলছে সেগুলোর আর কোনো মূল্যই থাকবে না। বরং যেটি করতে হবে সেটি হলো মিয়ানমারে যে অন্তর্বর্তী সরকার আসছে তারা এ ধরনে নৃগোষ্ঠীগুলোর স্বার্থ রক্ষার কথা বলেছে। সেই সুযোগটি গ্রহণ করে তাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া। যাতে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যায়।

প্রসঙ্গত, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বৃহস্পতিবার বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংক কিছু অবজারভেশন দিয়েছে। যার কিছু কিছু আমাদের পছন্দ নয়। সংস্থাটির অবজারভেশনের মূল কথা হলো রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে ইন্টিগ্রেশন করা। বাংলাদেশ রিফিউজি সংক্রান্ত কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। তাই আমরা এগুলো গ্রহণ করতে বাধ্য নই। বিশ্বব্যাংক যেসব ইস্যু এনেছে সেগুলো আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে আনেনি। ইউএনএইচসিআর সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের অবজারভেশনের রেফারেন্স দিলে আমরা বিষয়টি জানতে পারি। তখনই বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, বিশ্বব্যাংকের এসব প্রস্তাব আমরা সংশোধন করতে বলেছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here