খবর ৭১: করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক পরিবর্তিত ধরন ডেল্টার প্রভাবে বিশ্বজুড়েই বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। একাধিক গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মূল করোনাভাইরাস ও এর অন্যান্য পরিবর্তিত ধরনসমূহের তুলনায় ডেল্টা অনেক সহজে ও দ্রুততার সঙ্গে এক পোষকের দেহ থেকে আরেক পোষকের দেহে সংক্রমিত হতে সক্ষম।
সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে জানা গেছে, টিকার ডোজ পূর্ণ করেছেন এমন ব্যক্তিরাও আক্রান্ত হচ্ছেন ডেল্টায়।
যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম সরকারি স্বাস্থ্য সেবাসংস্থা পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড (পিএইচই) শুক্রবার জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যে করোনায় আক্রন্ত হয়ে বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ৩ হাজার ৬৯২ জন রোগী এবং তাদের মধ্যে ২২ দশমিক ৮ শতাংশ রোগীই করোনা টিকার ডোজ পূর্ণ করেছেন।
সিঙ্গাপুরে এই হার আরও বেশি। জুলাই মাসে দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৯৬ জন এবং এই আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ করোনা টিকার দুই ডোজ পূর্ণ করেছেন বলে জানা গেছে।
ইসরায়েলের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে সম্প্রতি দেশটির বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের ৬০ শতাংশই টিকার ডোজ পূর্ণ করেছেন। আক্রান্তদের প্রায় সবারই বয়স ৬০ এর ঊর্ধ্বে।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
ব্রিটেনের অণুজীববিদ্যা বিশেষজ্ঞ (মাইক্রোবায়োলজিস্ট) শ্যারন পিকক ডেল্টা ধরনকে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘সভ্যতার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এর চেয়ে সংক্রামক ও প্রাণঘাতী ভাইরাস আর দেখা যায়নি।’
ইসরায়েলের গত এক মাসের করোনা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেশটির সরকারি স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ জানিয়েছে, ফাইজার-বায়োএনটেকের করোনা টিকা- যা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকর করোনা টিকাসমূহের একটি হিসেবে স্বীকৃত, ডেল্টার বিরুদ্ধে মাত্র ৪১ শতাংশ কার্যকর।
তবে দেশটির স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই গবেষণা এখানেই শেষ নয় এবং এ বিষয়ক আরও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে।
ইসরায়েলের বেন গুরিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক নাদাভ ডেভিডোভিচ রয়টার্সকে বলেন, ‘সমস্যা হলো- টিকার ডোজ যিনি নিয়েছেন, তিনি হয়তো এর থেকে সুরক্ষা পাচ্ছেন, কিন্তু তার মাধ্যমে এই ভাইরাসটি আশপাশের এলাকায় ছড়াচ্ছে এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বল অ্যান্টিবডির লোকজন তাতে আক্রান্ত হচ্ছেন।’
‘আমরা যারা করোনা টিকাকে ম্যাজিক বুলেট মনে করেছিলাম এবং ভেবেছিলাম টিকা নেওয়ার পর সব সমস্যা কেটে যাবে, তাদের জন্য ডেল্টা একই সঙ্গে একটা বড় ধাক্কা ও শিক্ষা।’
চীনে সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, মূল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের তুলনায় ডেল্টায় আক্রান্ত রোগীদের নাকে ১০০০ গুণ বেশি ভাইরাস থাকে, যা নিশ্বাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সান ডিয়াগো শহরের লা জোলা ইনস্টিটিউট অব ইমিউনোলজির গবেষণায় দেখা গেছে যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হওয়া করোনার পরিবর্তিত ধরন আলফার তুলনায় ৫০ শতাংশ অধিক সংক্রামক ডেল্টা।
ইনস্টিটিউটের জিনোমিক্স বিশেষজ্ঞ এরিক টপল জানিয়েছেন, অন্যান্য ভাইরাসের তুলনায় ডেল্টা অনেক কম সময়ের মধ্যে বংশবিস্তার করতে সক্ষম এবং দৈহিকভাবেও অন্যান্য ভাইরাস তো বটেই, মূল করোনাভাইরাস ও এর অন্যান্য পরিবর্তিত ধরনসমূহের চেয়ে পরিপূর্ণ।
রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘এ কারণেই করোনা টিকাসমূহ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এখন আমাদের সামনে লড়াই দু’টি; প্রথম- ডেল্টাকে প্রতিহত করা এবং দ্বিতীয়- স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা।’
তবে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ও সংক্রামক অসুখ বিভাগের অধ্যাপক কার্লোস ডেল রিও অবশ্য মনে করেন টিকার গঠনগত কারণেই ডোজ সম্পূর্ণ করার পরও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষজন।
রয়টার্সকে এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘টিকা যখন প্রস্তুত করা হয়েছিল, তখন সবার চিন্তা ছিল এ রোগে গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যু ঠেকানো। সংক্রমণ ঠেকানোর বিষয়টি তখন কারো চিন্তাতেই আসেনি।’
‘এটা ঠিক, যে টিকার ডোজ সম্পূর্ণ করার পরও করোনায় আক্রান্ত হওয়া হতাশাজনক, কিন্তু যে চিন্তা থেকে টিকাসমূহ প্রস্তুত করা হয়েছিল, তা এটি ঠিকই করে যাচ্ছে।’