খবর ৭১: দক্ষিণ পশ্চিম চীনে হিমালয়ের কোলে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক এক সম্প্রদায়ের নাম মসুও। অঞ্চলটি তথাকথিত নারী শাসিত এক অভিনব সাম্রাজ্য।
চীনের ইউনান প্রদেশে পাহাড়ের কোলে মসুও সমাজে নারীরাই সবকিছু। তাদের সমাজে পুরুষরা গৌণ। পুরুষের যৌন সংসর্গ ছাড়া যেহেতু সন্তান উৎপাদন সম্ভব নয়, তাই মসুও সমাজে পুরুষের প্রয়োজন ভবিষ্যত বংশধর তৈরির জন্য। এর বাইরে পুরুষের সাথে সম্পর্ককে তাদের সমাজে নিরুৎসাহিত করা হয়।
মসুও জনগোষ্ঠীকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন পেশায় আইনজীবী চু ওয়াই হং।
তিনি ২০০৬ সাল পর্যন্ত কাজ করতেন সিঙ্গাপুরে একটা বড় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ আইনজীবী হিসেবে। ওই বছর তার শহুরে ব্যস্ত জীবন থেকে আগাম অবসর নিয়ে মিজ চু ওয়াই হং যখন তার পূর্বপুরুষের দেশ চীনে বেড়াতে যান, তখন হঠাৎই তিনি দেখতে পান পাহাড়ের বাসিন্দা এই বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায়ের। সঙ্গে সঙ্গে তাদের দারুণ ভালো লেগে যায় চু ওয়াই হংয়ের।
চু ওয়াই হং বলেন, নারীরা সেখানে দারুণ ক্ষমতাশালী। আপনি সেখানে গেলে দেখবেন এ সম্প্রদায়ের নারীদের মধ্যে কী পরিমাণ আত্মবিশ্বাস- সেটা কিন্তু তাদের স্বভাবজাত। আমাদের নারীদের মধ্যে এটা সচরাচর দেখা যায় না। এরা কিন্তু সেভাবে শিক্ষিত নয়, এরা কৃষক, কিন্তু আত্মবিশ্বাসে এরা যেন টগবগ করছে।
পাহাড়ের প্রায় ৩ হাজার মিটার উচ্চতায় অপূর্ব সুন্দর একটা হ্রদ নাম ‘লুগু লেক’। তার চারপাশে চমৎকার ঝাউবন। পাহাড়ে ঘেরা চোখ জুড়ানো দারুণ এলাকা। প্রত্যেকেই কৃষিজীবী আর খুব শান্ত ধীরস্থির জীবনযাত্রা সেখানে, ব্যাখ্যা করছিলেন মিজ ওয়াই হং।
সিঙ্গাপুরে মিজ ওয়াই হং এর কর্মজীবন ছিল খুবই সফল। কিন্তু তা ছিল অমানসিক রকম ব্যস্ত। রোজই প্রায় রাত ১২টা পর্যন্ত তাকে কাজ করতে হতো, প্রায়ই সপ্তাহে সাত দিন।
কয়েক দশক এভাবে চলার পর একদিন সকালে উঠে তিনি ঠিক করলেন, সাফল্য আর অর্থের বাইরে যে জীবন, তাকে জানতে তিনি বেরিয়ে পড়বেন। তাই কাজে ইস্তফা দিলেন।
চু ওয়াই হং যখন ২০০৬ সালে লুগু লেকে যান, তখনও সেখানে পর্যটকদের আনাগোনা প্রায় ছিলই না। বাইরের মানুষের প্রভাবও তেমন পড়েনি। তিনি তখনও ভাবেননি যে সেখানেই তিনি ভবিষ্যতে তার ঘর বাঁধবেন।
মসুও একটি ছোট প্রাচীন সম্প্রদায়। সংখ্যায় তারা ৪০ হাজারের মতো। মূলত স্বনির্ভর জাতিগোষ্ঠী। কঠোর ধর্মবিশ্বাস আর সংস্কৃতি কেন্দ্রিক তাদের জীবনযাপন।
মিজ ওয়াই হং যেদিন সেখানে গিয়ে পৌঁছান, সেদিন মসুও নারীরা তাদের প্রথাগত উজ্জ্বল সাজপোশাক পরে তাদের পাহাড়ের দেবীর উৎসব উদযাপন করছিলেন।
তারা খুব মজা করে নাচ-গান করছিল, আগুন জ্বালিয়ে খাবার রান্না করছিল আর পর্বতের দেবীর সামনে ধূপ জ্বালাতে সবাই পাহাড় ভেঙে উপরে উঠছিল। পাহাড়ের মাথায় তাদের দেবী ‘গামু’র মন্দির। তাদের বিশ্বাস এ দেবীই তাদের রক্ষাকর্ত্রী। তারা বলে, তাদের এই দেবী নাচগান ভালোবাসেন, মদ্যপান, বহুগামিতা তার খুব পছন্দ। তাই এ দেবীকেই তারা অনুসরণ করে।
মসুও নারীদের বক্তব্য, দেবীর মতো আমাদের জীবনেও একাধিক পুরুষসঙ্গী চাই। আমরা একজনের সাথে আটকে থাকতে চাই না।
মসুওদের জীবন নিয়ে তিনি বই লিখেছেন ‘কিংডম অব উইমেন’। মসুওদের ভাষাও শিখেছেন তিনি, তাদের সাথে বসবাস করেছেন।
প্রথাগতভাবে মসুওরা মাতৃতান্ত্রিক। অর্থাৎ তাদের বংশ পরম্পরা মায়ের দিক থেকে। তাদের সমাজে মাতামহী বা প্রমাতামহী সবচেয়ে ক্ষমতাশালী। মেয়ে মায়ের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।
মসুও পরিবারের কন্যারা ভাই বা ছেলের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়। ছেলেরা কখনও বাসা ছেড়ে কোথাও যায় না। বোনের পরিবারেই থাকে।
তবে ভবিষ্যত প্রজন্মে পরিবারের মাথা কে হবে, সেটা কোন কন্যাসন্তান পরিবারের অগ্রজ, সেটা বিচার করে তারা ঠিক করে না। পরিবারে যে কন্যা সন্তান সবচেয়ে বুদ্ধিমতী, আর সবচেয়ে পরিশ্রমী সেই পরিবারের মাথা হয়।
মেধা ও কর্মদক্ষতা বিচার করে সেটা ঠিক করে দেন পরিবারে মায়ের দিকে জীবিত সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ নারী। পরিবারে সবাইকে তিনি নির্দেশ দিয়ে জানিয়ে দেন ভবিষ্যতে ওই পরিবার কার কর্তৃত্ব মেনে নেবে।
মসুওদের লোক সংস্কৃতিতে তাদের বিশ্বাস যে পুরুষের ভূমিকা হলো শুধু সন্তান উৎপাদনে সাহায্য করা। তাদের ব্যাখ্যায়, নারীর শরীরে নতুন জীবনের যে বীজ সুপ্ত আছে, পুরুষ তাকে অঙ্কুরিত করবে। সেই বীজে যখন প্রাণের সঞ্চার হবে, তখন থেকেই সেই শিশুর মালিক তার গর্ভধারিণী মা।
বাবার ওই শিশুতে কোনো অধিকার নেই। সে শুধু বীজে পানি দিয়ে তাকে অঙ্কুরিত করেছে। শিশুর জীবনে বাবার আর কোনো ভূমিকাই থাকে না।
মসুও পরিবারে শিশুরা যেহেতু মায়ের বাড়িতে বেড়ে ওঠে, তাই ঘরে পুরুষ বলতে বাবার চেয়ে তারা বেশি চেনে মামাকে বা মায়ের বংশের যে পুরুষ সেই পরিবারে থাকেন। সন্তানের বাবার পিতৃত্বে কোনো অধিকার থাকে না।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।