উজ্জ্বল রায়: শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রার দিন পূর্ণিমার এই পূন্য তিথিতে ভবতারিণী মায়ের এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। সন তারিখ হিসেবে দিনটি ছিল ১৮৫৫ সালের ৩১মে জৈষ্ঠ্য মাসের ১৮ তারিখ ! কিন্তু তিথি হিসেবে এই স্নানযাত্রার দিনটিকেই মন্দির প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
ফিরে দেখা সেদিনের ইতিহাস – খবরটা চারদিন আগেকার। আর সেটাকেই ফলাও করে ছেপেছে ‘সংবাদ প্রভাকর’। ঈশ্বর গুপ্তের কাগজ। ২২ জ্যৈষ্ঠ ১২৬২ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ৪ জুন ১৮৫৫-র কাগজে ছাপা হয়েছিল দক্ষিণেশ্বরে কালীমন্দির প্রতিষ্ঠার সংবাদ—‘জানবাজার নিবাসিনী পুণ্যশীলা শ্রীমতী রানী রাসমণি জ্যৈষ্ঠ পৌর্ণমাসী তিথি যোগে দক্ষিণেশ্বরের বিচিত্র নবরত্ন ও মন্দিরাদিতে দেবীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। ওই দিবস তথায় প্রায় লক্ষ লোকের সমাগম হইয়াছিল।’ মন্দির প্রতিষ্ঠাত্রী রানি রাসমণি ছিলেন সর্ব অর্থেই ব্যতিক্রমী, সমসাময়িক রক্ষণশীলতার মুখে ছুঁড়ে দেওয়া নিত্য চ্যালেঞ্জ। তা ছাড়া একের পর এক বাধায় মন্দির প্রতিষ্ঠার তারিখ ক্রমশ পিছোচ্ছিল ! মন্দির তৈরি হওয়ার আগেই মূর্তি তৈরির বরাত দিয়ে বসেছিলেন দাঁইহাটের বিখ্যাত শিল্পী নবীন ভাস্কর কে । মূর্তি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কালো ধূসর আগ্নেয়শিলা ব্যাসল্ট পাথর দিয়ে তৈরি কালী। চতুর্ভুজা দেবীমূর্তির উচ্চতা তিন ফুটেরও কম, সাড়ে তেত্রিশ ইঞ্চি। প্রচলিত কালীমূর্তির মতোই দেবীর গলায় মুণ্ডমালা। কিন্তু কোমরে কাটা হাত গেঁথে তৈরি কটিবন্ধনী নেই। দেবী শায়িত শিবের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। শিবের মূর্তিটি সাদা মার্বেল পাথরের। মূর্তি তৈরি শেষ হওয়ার পর সেটাকে একটা কাঠের বাক্সে সযত্নে ভরে রাখা হয়। পাছে কোনওভাবে মূর্তিটি ভেঙে যায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেজন্যই এই ব্যবস্থা। সেই মূর্তি বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে আছে অনেকদিন। আর দেরি করার পক্ষপাতী ছিলেন না জানবাজারের রানি। মন্দির প্রতিষ্ঠা হবে, আর দেরি করা চলবে না। এই হল তাঁর মত। সাত বছর আগে ১৮৪৮-এ প্রথম মন্দির নির্মাণের ভাবনাটা মাথায় আসে। নৌকাযোগে কাশী যাওয়ার পথে স্বপ্নাদেশ লাভ। কাশী যাওয়ার আর দরকার নেই। ভাগীরথী তীরেই দেবীকে প্রতিষ্ঠা করে অন্নভোগ নিবেদনের আদেশপ্রাপ্তি। স্বপ্নে আদেশ পাওয়া মাত্র কোমর বেঁধে কাজে নেমে পড়েন রানি। আর পড়ামাত্র একটার পর একটা বাধার মুখোমুখি। প্রথম বাধা জমি নিয়ে। গঙ্গার পশ্চিমকূল, বারানসী সমতুল। স্বাভাবিকভাবে প্রথম খোঁজ চলল সেখানে। অর্থাৎ বালি-উত্তরপাড়ায়। রানি ধর্মপ্রাণা এবং বিত্তশালী। সুতরাং মন্দিরের জমির জন্য যে-কোনও অঙ্কের অর্থ দিতে তৈরি ছিলেন। তবু জমি পাওয়া গেল না। কারণটা কী ছিল তা স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ জানিয়েছিলেন ‘লীলাপ্রসঙ্গ’-এর রচয়িতা স্বামী সারদানন্দকে। বালি-উত্তরপাড়ার জমিদারদের বক্তব্য ছিল, ‘তাঁহাদের অধিকৃত স্থানের কোথাও অপরের ব্যয়ে নির্মিত ঘাট দিয়া তাঁহারা গঙ্গায় অবতরণ করিবেন না।’ এই জমিদারদের নেতৃত্বে ছিলেন নড়াইলের জমিদার রতন রায় আর সাতক্ষীরার জমিদার প্রাণনাথ চৌধুরি। শোনা যায় রতন রাসমণির প্রিয় জামাই মথুরা মোহন বিশ্বাসকে বলে পাঠিয়েছিলেন, স্ত্রীলোকের এত বাড়াবাড়ি ভাল নয়। এই রতন মহা ঘটা করে বরানগরের কুঠিঘাটে দশমহাবিদ্যার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ভাগনে হৃদয়কে নিয়ে সেই মন্দির দর্শন করতে যান শ্রীরামকৃষ্ণ। ততদিনে রামরতনের মৃত্যু হয়েছে। মন্দিরের বেহাল দশা। নিত্য সেবাটুকুও প্রায় অনিয়মিত। কষ্ট পেলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। রানির জামাই মথুরামোহনকে জানালেন সেকথা। শুনলেন রানিও। ঠিক করলেন প্রতি মাসে দশ মহাবিদ্যা মন্দিরে দুমণ চাল আর দুটাকা পাঠাবেন। নিয়মিত ভোগের ব্যবস্থা করবেন। যে ব্যক্তি একদিন তাঁর মন্দির প্রতিষ্ঠায় বাধ সেধেছিল, তাঁরই প্রতিষ্ঠা করা মন্দিরের দেখভালের দায়িত্ব নিতে হল রাসমণিকেই। ন্যায়ের অদ্ভুত গতিপথ। অগত্যা জমির খোঁজ শুরু হল পূর্বপাড়ে। প্রথমে ভাটপাড়ায়। সেখানে বলরাম সরকার জমি দিতে রাজি হলেন। কথাবার্তা পাকা। কিন্তু শেষমুহূর্তে ভাটপাড়ার গোঁড়া ব্রাহ্মণদের চাপে বেঁকে বসলেন। এক বিধবা মন্দির তৈরি করবে, এটা মেনে নিতে পারেনি গোঁড়া হিন্দুসমাজ। শেষমেশ জমি কেনা হল দক্ষিণেশ্বর গ্রামে। প্রাচীনকালে এই জায়গাটার নাম ছিল শোণিতপুর। বানরাজার রাজত্বের মধ্যে ছিল ওই গ্রাম। বানরাজাই নাকি সেখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শিবলিঙ্গ। সেই শিবলিঙ্গের নাম অনুসারে জায়গাটার নাম দক্ষিণেশ্বর। সেখানেই পাওয়া গেল জমি। একলপ্তে ষাট বিঘা। জমির মালিক কোনও হিন্দু জমিদার নন। তিনি খ্রিস্টান। নাম হেস্টি। কলকাতায় তখন সুপ্রিম কোর্ট। সেখানকার অ্যাটর্নি তিনি। জমি কিনতে খরচ হল ৫৫ হাজার টাকা। জমির গড়ন খানিকটা কচ্ছপের পিঠের মতো, অর্থাৎ তন্ত্রমতে শাক্তসাধনার উপযুক্ত এই জমি। জমি কেনার বাধা কাটানোর পর মন্দির নির্মাণে বাধা। মন্দির কেমন হবে সে সম্পর্কে রানির ধারণা ছিল স্পষ্ট। মন্দির হবে নবরত্ন মন্দির। অর্থাৎ মন্দিরের মাথায় থাকবে নয়টি চূড়া। প্রথম ধাপে চারটে। তার ওপরের ধাপে আরও চারটে। আর একবারে মন্দিরশীর্ষে একটা। রাসমণি মন্দিরের এই গঠনশৈলীর ধারণা পেয়েছিলেন সম্ভবত একটি রাধাকৃষ্ণর মন্দির দেখে। মণ্ডলদের রাসমন্দির। টালিগঞ্জের কাছে। মণ্ডল পরিবারের আদিনিবাস ছিল বজবজের কাছে বাওয়ালিতে। সেখানেই তাঁদের জমিদারি প্রায় আড়াইশোটা গ্রামজুড়ে। পরিবারের তিন পুরুষ সদস্য, তিন ভাই, কলকাতায় টালি নালার কাছে থাকতে শুরু করেন। ইংরেজদের সঙ্গে তাঁদের দারুণ দহরম-মহরম। সেই সখ্যকে আরও পোক্ত করতেই সম্ভবত তাঁদের কলকাতায় বাস করার সিদ্ধান্ত। ওই তিন ভাইয়ের একজন প্যারীলাল মণ্ডল। স্নান করতে গিয়েছিলেন আদিগঙ্গায়। সেখানেই জলের তলায় পান রাধাকৃষ্ণের মূর্তি। জল থেকে তুলে এনে সেই মূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জমিদারির দশ বিঘা জমির ওপর তৈরি হয় মন্দির। সেই মন্দিরের স্থাপত্যে ছিল ওই নবরত্ন শৈলী। মন্দিরের মাথায় তিন ধাপে নয়টি চূড়া। প্যারীলালরা রাধাকৃষ্ণ মন্দির চত্বরেই নির্মাণ করেছিলেন শিবমন্দির। নয়টি। মন্দির তৈরি হয়েছিল ১৮৪৭ সালে। দক্ষিণেশ্বর মন্দির নির্মাণের আট বছর আগে। জানবাজারের রাজবাড়ির মেয়ে, রাসমণির প্রপৌত্রী, নগেন্দ্রবালার বিয়ে হয় মণ্ডল পরিবারে। সেই সূত্রে রানির রাসমন্দিরে যাতায়াত। তখনই তাঁর হয়তো মনে ধরেছিল ওই স্থাপত্যশৈলী। মনে বাসা বেঁধেছিল নবরত্ন কালীমন্দিরের বিপরীতে বারোটা শিবমন্দির তৈরির ভাবনা। তবে শিবমন্দিরের নির্মাণশৈলী আলাদা। সেগুলোতে একেবারে বাংলার নিজস্ব আটচালা ঘরানার ছাপ। শিব আর শক্তির মন্দিরের পাশাপাশি রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের কথাও ভেবেছিলেন রানি। শাক্ত-বৈষ্ণব বিবাদ-বিরোধের আবহের মধ্যেই সমন্বয়ের ভাবনা। বিবাদ-বিসংবাদের ঊর্ধ্বে সংহতির বাতাবরণ প্রতিষ্ঠার কথা। একই পাঁচিলের বেষ্টনীতে শাক্ত, শৈব আর বৈষ্ণব মতাদর্শের মহামিলন। প্রথমে ঠিক হয়েছিল, দেশীয় মিস্ত্রিদের দিয়ে তৈরি হবে মন্দির। তাদের বরাতও দেওয়া হয়। কিন্তু কাজ এগোতে লাগল ধীরগতিতে। তার মধ্যে গঙ্গার প্রবল বানে সব নষ্ট। তখন খানিকটা বাধ্য হয়েই রানি বরাত দিলেন সাহেবি নির্মাণ সংস্থা ম্যাকিনটসবার্ন কোম্পানিকে। ১৮৫০ সালে তারা মন্দির তৈরির কাজ শুরু করল। প্রথমে ঠিক হয়েছিল গঙ্গার তীরে পোস্তা আর ঘাট তৈরি করবে তারা। সেই মতো চুক্তি। বরাত দেওয়া হয় এক লাখ ষাট হাজার টাকার। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সুচারু ভাবে কাজটা শেষ করে তারা। রানি খুশি হন। দক্ষিণেশ্বরে মন্দির চত্বরে যাবতীয় নির্মাণকর্মের দায়িত্ব পায় তারা। কালীমন্দির, শিবমন্দির, বিষ্ণুমন্দির থেকে শুরু করে পুকুরের ঘাট বাঁধানো, নহবতখানা তৈরি করা, পুরো জায়গাটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, সব কিছুর। আজও ওই কোম্পানির নেতাজি সুভাষ রোডের অফিসে পুরোনো ফাইল ঘাঁটলে দেখতে পাওয়া যাবে ইংরেজিতে লেখা কটা লাইন। কোম্পানি কেবল মন্দির তৈরির ব্যাপারে অনন্যতার ছাপ রেখেছিল তা নয়, নদীর তীরের জমি যাতে ধসে নদীর গর্ভে চলে না যায়, সে ব্যাপারেও দুর্দান্ত বন্দোবস্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। ‘প্রোটেকশন ওয়ার্কস এগেইনস্ট ইরোসন’ এবং ‘কনস্ট্রাকটিং দ্য দক্ষিণেশ্বর টেম্পল’, উভয় ক্ষেত্রেই তারা ‘ইউনিক ডিস্টিংশন’ দেখাতে সমর্থ হয়েছিল। এই সাফল্যের কারণে তারা রানির কাছ থেকে নয় লক্ষেরও বেশি টাকা পেয়েছিল। কিন্তু সেসব তো অনেক পরের কথা। ১৮ মার্চ ১৮৫৩-র সংবাদপ্রভাকর পত্রিকায় মন্দির-সংক্রান্ত একটা খবর বেরিয়েছিল। ‘আমরা শুনিয়াছি…শ্রীমতী (রানী রাসমণি) আগামী বৈশাখী পূর্ণমাসী তিথিতে দক্ষিণেশ্বরে মহতী কীর্তি স্থাপন করিবেন অর্থাৎ ওই দিবস গুরুতর সমারোহ সহযোগে কালীর নবরত্ন দ্বাদশ শিবমন্দির ও অন্যান্য দেবালয় এবং পুষ্করিণী প্রভৃতি উৎসর্গ করিবেন । কিন্তু তা আর হল কই ? জমি কেনা এবং মন্দির নির্মাণ-সংক্রান্ত বাধার পর এবার সমস্যা পূজারিকে নিয়ে। লীলাপ্রসঙ্গকারের ভাষায়, ‘এখানেও আবার প্রচলিত সামাজিক প্রথা তাঁহার বিরুদ্ধে।’ কী, কী সমস্যা এবার? সে যুগে শূদ্ররা মন্দির প্রতিষ্ঠা করলে ব্রাহ্মণরা সে মন্দিরের প্রসাদ খেতেন না, এমনকী সেখানকার দেবমূর্তিকে প্রণাম পর্যন্ত করতেন না। সুতরাং রাসমণির মন্দিরে পুরোহিত হতে তাঁরা নারাজ। আবার ওদিকে জানবাজারে তাঁদের বাড়ির কুলপুরোহিত রামসুন্দর চক্রবর্তী বা তাঁর বংশধরদের রানি অশাস্ত্রজ্ঞ বলে মনে করতেন। তাই তিনি চেয়েছিলেন গুরুবংশীয়দের ‘ন্যায্যবিদায় আদায়’ অক্ষুণ্ণ থাকুক কিন্তু নতুন মন্দিরে নিত্য দেবসেবার ভার কোনও ‘শাস্ত্রজ্ঞ সদাচারী’ ব্রাহ্মণের হাতে অর্পিত হোক। কিন্তু রানি চাইলেই তো আর হল না। শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণরা সে দায় নেবেন কেন ? শূদ্রাণী প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে সেবায়েতের দায়িত্ব নিলে তো সমাজে ব্রাত্য হতে হবে। কে সেই ঝুঁকি নেবে? এবার পরিত্রাতা হয়ে এগিয়ে এলেন রাসমণির দুজন কর্মচারী, মহেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং রামধন ঘোষ। প্রথমজনের বাড়ি শিহরে আর দ্বিতীয়জনের দেশড়াতে। শিহরে রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বোন হেমাঙ্গিনীর শ্বশুরবাড়ি। আর দেশড়ার কাছেই কামারপুকুর গ্রাম। সেখানে থাকতেন রামকুমার নিজে। ফলে, রানির দুই কর্মচারীরই বিশেষ পরিচিত ছিলেন রামকুমার। শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ। নীতিনিষ্ঠ এবং বিচক্ষণ। বছর তিনেক আগেই ভাই গদাধরকে নিয়ে রামকুমার চলে এসেছেন কলকাতায়। এই গদাধরই হলেন পরবর্তীকালের শ্রীরামকৃষ্ণ। কলকাতার ঝামাপুকুরে দিগম্বর মিত্রের বাড়ি। সেখানেই তখন চালু হয়েছে রামকুমারের স্মৃতি-শাস্ত্র-ব্যাকরণশিক্ষার টোল। সেখানে দাদার টোলে শিক্ষা পাচ্ছেন গদাধর। রানির দুই কর্মচারী গিয়ে ধরলেন রামকুমারকে। তিনিই তখন অগতির গতি। মহেশচন্দ্র এবং রামধনের পীড়াপীড়িতে মন্দিরের পৌরোহিত্য করতে রাজি হলেন রামকুমার। এত সব বাধা পেরিয়ে ‘কালীপদ অভিলাষিণী’ রানি রাসমণির কালীমন্দিরের প্রতিষ্ঠা। ১৮৫৫ সালের ৩১শে মে , ১৮ই জ্যৈষ্ঠ , বৃহস্পতিবার, পুণ্য স্নানযাত্রার দিনে।।
মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন পঞ্চাশের বেশি গৌড়ীয় ব্রাহ্মণ মন্ত্রপাঠের দায়িত্ব সামলালেন। তাঁদের সব্বাইকে দান-দক্ষিণা বাবদ রেশমবস্ত্র, উত্তরীয় আর স্বর্ণমুদ্রা দিলেন রানি। অতিথি আপ্যায়ন থেকে কাঙালি ভোজন কোথাও যাতে কোনও ত্রুটি না থাকে সেদিকে ছিল তাঁর সতর্ক দৃষ্টি। হুগলির কুলিহান্তা থেকে প্রবোধচন্দ্র সাঁতরার বাবার কাকা-কাকিমা এসেছিলেন সেদিনের সেই বিশাল অনুষ্ঠানে। এহেন প্রবোধচন্দ্র সেদিনের কথাপ্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ‘শালবাড়িয়া তালুক হইতে দুটি হস্তী আসিয়াছিল, ওই হস্তীপৃষ্ঠে অতি উত্তম বিশুদ্ধ ঘৃত আনীত হইয়াছিল।’ সংবাদপ্রভাকরের খবর অনুযায়ী, সেদিন লোক খাওয়ানোর জন্য শুধু কলকাতা নয়, পানিহাটি, বৈদ্যবাটি, ত্রিবেণী প্রভৃতি জায়গা থেকে ৫০০ মণ সন্দেশ আনা হয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে আরও প্রকাশ, ‘নবরত্নের সম্মুখস্থ নাটমন্দির অতি রমণীয় রূপে সজ্জীভূত হইয়াছিল, ঝাড়লণ্ঠন প্রভৃতিতে খচিত হয়, বরাহনগর অবধি নাটমন্দির পর্যন্ত রাস্তার উভয় পার্শ্বে বান্ধা রোশনাই হয়, কোনোরূপ অনুষ্ঠানের কোনোপ্রকার বৈলক্ষণ হয় নাই।’ সত্যিই কোথাও আয়োজনে এতটুকু ত্রুটি হতে দেননি জানবাজারের রানি। ব্রাহ্মণ এবং গোস্বামীরা তো বটেই উপস্থিত কাঙালিদের পেটপুরে খাওয়ানোর পর তাদের নগদ দক্ষিণা দেওয়া হয়, কারওকে সিকি, কারওকে আধুলি, আবার কারওকে গোটা এক টাকা। সব মিলিয়ে সেদিন রাসমণির খরচ হয়েছিল প্রায় দুলক্ষ টাকা পূর্বদিকে যে জমি তার মালিক কাশীনাথ চৌধুরি। পশ্চিমদিকে বয়ে চলেছে গঙ্গা। উত্তরে ইংরেজ সরকারের বারুদ কারখানা ‘ম্যাগাজিন’। আর দক্ষিণদিকে হেস্টিসাহেবের কারখানা (পরবর্তীকালে এই কারখানাটি কিনে নেন যদুনাথ মল্লিক, তৈরি করেন তাঁর বাগানবাড়ি)। এরই মধ্যে গড়ে উঠল মন্দির। চারকোনা চাতাল। লম্বা প্রায় ৪৪০ ফুট, আর চওড়া প্রায় ২২০ ফুট। চাতালের পূর্বদিকে মূল মন্দির। গর্ভগৃহে দেবীমূর্তি দক্ষিণমুখী। দেবী সর্বত্র পরিচিতা ভবতারিণী নামে। ভবসংসারে তিনিই ত্রাতা। তাই ভক্তির আখরে লৌকিক ওই নাম। অথচ দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের দলিলদস্তাবেজে তিনি ভিন্ন নামে উল্লিখিতা। আমরা সাধারণভাবে যাঁকে ‘ভবতারিণী’ বলে পূজা নিবেদন করি, নথিপত্রে তাঁরই নাম ‘জগদীশ্বরী’। ভবসংসারে যাবতীয় যন্ত্রণার ত্রাতা কাগজকলমে জগতের ঈশ্বরী। নামে ফারাক থাকলেও ভাবে খুব একটা অসঙ্গতি নেই। মন্দির প্রতিষ্ঠার দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রবোধ সাঁতরা লিখেছেন, সেদিন দক্ষিণেশ্বরে দইয়ের পুকুর, পায়েসের সমুদ্র, ক্ষীরের হ্রদ, দুধের সাগর, তেলের সরোবর, ঘিয়ের কুয়ো, লুচির পাহাড় আর মিষ্টির স্তূপ তৈরি হয়েছিল। ছিল রাশি রাশি কলার পাতা আর মাটির থালাবাটির পাহাড়। সেসবের মধ্যে ছিলেন গদাধরও। কিন্তু ওসব কিচ্ছুটি দাঁতে কাটেননি তিনি। সারাদিন ঘুরে ঘুরে সব কিছু দেখেছেন। সন্ধেবেলায় একপয়সা খরচ করে মুড়ি–মুড়কি কিনেছেন। তাই খেয়ে ফিরে গিয়েছেন ঝামাপুকুরে। দাদা পুরোহিতের চাকরি করছেন, এ ব্যাপারটা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। কদিন পর অবশ্য ঝামাপুকুরের পাট চুকিয়ে চলে এসেছেন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে। সেটাও চাকরির জন্য নয়। দাদার টানেও নয়। এমনকী ভবতারিণী বা জগদীশ্বরীর প্রতি ভক্তির জন্যও নয়। ভবিষ্যতের শ্রীরামকৃষ্ণ গদাধর হিসেবে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে এসেছিলেন স্রেফ গঙ্গার টানে। গঙ্গার তীরে নিজে রান্না করে খেতে পারবেন, দাদার কাছ থেকে এই প্রস্তাব পাওয়ার পর। কথাটা মনে ধরেছিল তাঁর। কালকে হরণ করেন যিনি তিনিই কালী। সেই দেবীই বুঝি কালান্তরে গদাধরকে শ্রীরামকৃষ্ণে বদলে দেবেন বলেই অন্য অজুহাতে টেনে এনেছিলেন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে। পাকাপাকি ভাবে। সেদিন যদি মন্দির প্রতিষ্ঠা না হত, তা হলে আমরা রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ–কে পেতাম না। ভগিনী নিবেদিতা ‘স্বামীজিকে যেরূপ দেখিয়াছি’ গ্রন্থে সে কথাটা স্পষ্টাস্পষ্টি মনে করিয়ে দিয়েছেন। জানিয়েছেন, স্বামীজি তাঁদের বারংবার মনে করিয়ে দিতেন, এ সব কিছুই ‘নিম্নজাতির এক ধনবতী নারীর ভক্তির ফল’। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ‘ব্রাহ্মণ-প্রাধান্য- সংরক্ষণে দৃঢ়বদ্ধ হিন্দু রাজাগণ কর্তৃক এদেশ সম্পূর্ণ রূপে শাসিত হইলে ওইরূপ ঘটা কদাপি সম্ভব হইত না।’ দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দির কোনও বড়লোক জমিদার বাড়ির পুণ্যকামী বিধবার মন্দির প্রতিষ্ঠা নয়। তার নির্মাণের স্তরে স্তরে মিশে আছে একজন সাব-অলটার্ন নারীর লড়াই আর বাংলার রেনেসাঁসের একটা অধ্যায়। তাই দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির প্রতিষ্ঠার ইতিহাস তাৎপর্যের বিচারে আর পাঁচটা মন্দির নির্মাণের চেয়ে অনেকটাই আলাদা, একেবারে অন্যরকম।