ইটালির লাম্পেদুসা দ্বীপে বাংলাদেশি অভিবাসীদের ভিড়

0
350

খবর ৭১

গত দুই দিনে দুই হাজারেরও বেশী অভিবাসীরা এসে পৌঁছেছেন ইটালির লাম্পেদুসা দ্বীপে। এর মধ্যে একটি বড় অংশ বাংলাদেশি, যারা উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে দেশ ছেড়ে ইউরোপের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন।

৮ মে রোববার একদিনে ইটালির কোনো দ্বীপে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অভিবাসী এসেছেন৷ সেদিন মোট এক হাজার ৪০০জন ইটালির লাম্পেদুসা দ্বীপে অবতরণ করেন, যার মধ্যে বেশিরভাগই তিউনিশিয়া, আইভরি কোস্ট ও বাংলাদেশের নাগরিক৷

স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে যে অভিবাসীদের নিয়ে আসা নৌকার ঢল চলতে থাকে সোমবার পর্যন্ত৷ সিসিলিয়ান সংবাদপত্র জিওর্নালে দি সিসিলিয়া জানায় যে ২৪ ঘণ্টায় মোট ২০টি নৌকা শনাক্ত করা গেছে ও মোট দুই হাজার ১২৮জনকে নিকটবর্তী রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের নিবন্ধনকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷

শনিবার সারা রাত ধরে অভিবাসীদের নিয়ে একের পর এক নৌকা আসতে থাকে লাম্পেদুসায়৷ রোববার সকাল পর্যন্ত আসতে থাকে এমন বহু নৌকা, যার মধ্যে ছিল মাছ ধরার কাঠের নৌকাও৷ রোববার বিকাল পর্যন্ত এমন মোট নয়টি নৌকা এসে পৌঁছানোর কথা জানা গেছে৷ ইটালির তট থেকে কিছুটা দূরে এই নৌকাগুলি দেখা গেলে ইটালির সীমান্তরক্ষী ও কাস্টমস পুলিশের নৌকা তাদের পাহারা দিয়ে নিয়ে আসে বলে ইটালির সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে৷ সোমবার সকালে আরো চারটি নৌকায় এসে পৌঁছান আরো ৬৩৫জন৷

জিওর্নালে দি সিসিলিয়া জানাচ্ছে, আগত অভিবাসীদের অধিকাংশই পুরুষ, কিন্তু কিছু কিছু নারী, শিশু এমনকি নবজাতকও আছে৷ সংবাদ সংস্থা এপি ইটালির রেডিও সংস্থার বরাত দিয়ে জানিয়েছে যে, নিবন্ধনকেন্দ্র ভরে যাওয়ায় বহু অভিবাসীদের বাইরে তোষক পেতে রাত কাটাতে হয়েছে৷ কোভিড সংক্রমণ বিষয়ে নিশ্চিত হতে শয়ে শয়ে অভিবাসীদের কোয়ারেন্টিন করে একটি অব্যবহৃত ফেরিতে রাখা হয়৷

স্কাই টিজি২৪ টিভিকে লাম্পাদুসার মেয়র সালভাতোরে মারতেলো রোববার বলেন, ‘‘আমি বলেছি যে একদিন ভালো আবহাওয়া থাকলেই এই ধরনের নৌকাগুলিকে দেখা যায়৷’’ এএফপি জানিয়েছে যে মারতেলো ইতিমধ্যে অভিবাসনকে গুরুত্ব দেবার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘিকে৷

এই ধরনের অভিবাসী আগমনের নিন্দা জানিয়েছেন অতি-ডানপন্থি দল লিগ পার্টির নেতা মাত্তেও সালভিনি৷ সালভিনি ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী থাকাকালীন দ্বীপে কিছু অভিবাসীকে প্রবেশ করতে না দেওয়া বিষয়ে একটি মামলায় অভিযুক্ত৷ মামলাটি সিসিলিতে বর্তমানে চলছে৷

ভূমধ্যসাগরে বিপদে পড়া অভিবাসীদের জন্য হটলাইন পরিষেবা অ্যালার্ম ফোন জানিয়েছে যে ২৭ ঘণ্টায় মোট ছয়টি বিপদগ্রস্ত নৌকার কাছ থেকে বার্তা পায় তারা৷ এর মধ্যে দুটি নৌকার এখনও কোনো খোঁজ নেই৷

স্বপ্নের খোঁজে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে পাড়ি

জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএম-এর পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ সালের শুরু থেকে ইটালিতে এসেছেন পাঁচ লাখেরও বেশি অভিবাসী৷ ইটালিয়ান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৭ মে পর্যন্ত, দশ হাজার ৭২৫জন জলপথে এসেছেন, যার মধ্যে এক হাজার ২১৬জন বাংলাদেশি রয়েছেন৷

মধ্য ভূমধ্যসাগরের যে পথ সিসিলি ও উত্তর আফ্রিকার মাঝে রয়েছে, তা বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক অভিবসন পথের একটি৷ এই পথে ইউরোপে প্রবেশ করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত ৫০৬জন অভিবাসীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে৷

ব্র্যাকের অভিবাসন বিশেষজ্ঞ শরিফুল হাসান ঢাকা থেকে ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানান, কিছু নির্দিষ্ট জেলার মানুষদের মধ্যে একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে গ্রিস বা ইটালিতে পৌঁছানো তুলনামূলকভাবে সহজ ও সেখান থেকে সহজেই ইউরোপে কাজ করা যায়৷ হাসান বলেন, ‘‘তাদের বলা হয় যে, যে কোনো উপায়ে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে একবার ইটালি পৌঁছাতে পারলেই চাকরি পাওয়া সহজ৷’’

‘‘বাংলাদেশ বা ইউরোপে থাকা দালালদের বিশ্বাস করে ফেলে তারা৷ আর দালালরাও তাদের বলে যে সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে৷ কোনো দারিদ্র্য থাকবে না, ধনী হওয়া সহজ৷’’ মধ্যপ্রাচ্যে থাকা বাংলাদেশিদের পরামর্শ দেয় এই দালালরা যে, কোনো মতে ইউরোপ যেতে পারলে তাদের জীবন আরো সুখের হবে, জানান হাসান৷

বেশিরভাগ বাংলাদেশিদের বাস্তবতা আসলে ভিন্ন৷ তাদের কাছ থেকে আরো বেশি টাকা আদায়ের জন্যে এদের মধ্যে অনেককেই শুধু এক পাচারকারী চক্রের হাত থেকে অন্য চক্রের হাতে বিক্রি করে দেওয়া হয়৷ এই দালালরা শুধু বাংলাদেশ বা লিবিয়াতেই অবস্থান করে এমনটা নয়, বরং তুরস্ক ও দুবাইতেও ছড়িয়ে রয়েছে তাদের চক্র৷

‘‘প্রতি বছর এই সময়ে, অর্থাৎ মে-জুন থেকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস পর্যন্ত, দালালরা আরো বেশি মানুষকে ইউরোপে পাঠাতে চেষ্টা করে৷ যদি কিছু ফেসবুক গ্রুপগুলি দেখা যায়, তাহলে লক্ষ্য করা যাবে যে কিছু পাচারকারীরা সেখানে লিখছে যে তারা ১০০জনকে ইটালি পাঠিয়েছে, ফলে এখন আরেকটা দল আসতে পারে’’, জানান হাসান৷

তিনি বলেন, ‘‘এই সব দেশগুলি একসাথে মিলে সংযুক্ত পদক্ষেপ না নিলে এই পথে মৃত্যুর কোনো শেষ নেই৷’’

ইটালির কর্তৃপক্ষ বর্তমানে অভিবাসী উদ্ধারকারী নৌকার ওপর কড়াকড়ি চালাচ্ছে৷ এমন পরিস্থিতির মধ্যেই নতুন করে ইটালিতে আসছেন আরো অভিবাসী৷ বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন ও এনজিও পরিচালিত কিছু উদ্ধারকারী জাহাজ বর্তমানে মধ্য ভূমধ্যসাগরে সক্রিয়ভাবে বিপন্ন অভিবাসীদের বাঁচানোর কাজ করছে৷ গত সপ্তাহান্তে, সিসিলিতে সিওয়াচ-৪ নামের একটি উদ্ধারকারী জাহাজকে আটক করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে৷ এর আগে, পালেরমো শহরে ছয়মাস আটকে রাখা হয়েছিল সেই জাহাজটিকে৷

এই নির্দেশনা দেওয়া হয় কারণ একটি নিরাপত্তা পরিদর্শন দল জানায় যে জাহাজটিতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি লাইফজ্যাকেট ছিল৷ পাশাপাশি, তারা এটাও বলে যে জাহাজটির নিষ্কাশন ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ছিল না৷ কিন্তু অধিকারকর্মীদের মতে, এই নির্দেশনা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত মতামত সবই ছিল জাহাজটিকে কোনোমতে আটকানোর অজুহাত৷

নিরাপত্তাজনিত কারণে আরেকটি জাহাজ, সিওয়াচ-৩, আটক ছিল সিসিলির আওগুস্তা বন্দরে৷

(এএফপি, এপি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here