মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ: ‘আইলো আইলো আইলোরে রঙে ভরা বৈশাখ আবার আইলোরে’- বৈশাখের চিরচেনা এই গানের মধ্য দিয়ে হাজির হয়েছে বাংলা বর্ষের নতুন বছর ১৪২৮। নববর্ষ বাঙালির সহস্র বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রীতি-নীতি, প্রথা, আচার অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। প্রতিবছর জাঁকজমকভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হলেও এবার করোনা সংকটে হতাশা আর আশঙ্কার কালো মেঘ জমেছে গোটা বিশ্বজুড়ে। মহামারি উৎসব কেড়ে নিলেও শিক্ষার্থীদের মনে জল্পনাকল্পনার যেনো শেষ নেই। বাংলা নববর্ষকে ঘিরে নারী শিক্ষার্থীদের ভাবনা ও প্রত্যাশা তুলে ধরেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ।
বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির একটি গৌরবময় অধ্যায় হলো বাংলা সনের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ। এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন লোকউৎসব। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। অতীতের ভুল ত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষ।
বাংলা নববর্ষ একসময় আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষি, কারণ কৃষিকাজ ছিল ঋতু নির্ভর। এই কৃষিকাজের সুবিধার্থেই মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০/১১ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন। নতুন সনটি প্রথমে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিল পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়।
বাংলা নববর্ষের এদিনটি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছে মহাসম্মেলনের দিন। এ উৎসবের দিনে বাংলার ছেলেরাে পাঞ্জাবি-পাজামা, ধুতি এবং বাংলার তরুণীরা শাড়ি-চুড়ি, টিপস সহ রংবেরঙের সাজে বাঙালি হয়ে ওঠে।
হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকান-পাট ও ঘরে ঘরে পান্তা-ইলিশ, কাঁচামরিচ, ভর্তা, পেঁয়াজ সহ নানান বাঙালি খাবারের সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে প্রাণবন্তভাবে উদযাপন করে দেশের সর্বস্তরের জনগণ। এদিনে মৃৎশিল্পের হাড়ি-পাতিল, আসবাবপত্র ও নানান ধরনের খেলনার মেলা বসে। পাশাপাশি কুটিরশিল্প ও তাৎশিল্পের বস্ত্র ও আসবাবপত্রে জমজমাট হয়ে উঠে বৈশাখী মেলা। এছাড়াও স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, হস্তশিল্পজাত সামগ্রী এই মেলায় পাওয়া যায়। পোশাক, খাদ্য ও সংস্কৃতিতে বাংলার শহরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চল গুলো বাঙালি ঐতিহ্যকে নিখুঁতভাবে লালন করে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো পহেলা বৈশাখে আমরা কেবল একদিনের জন্য বাঙালি হয়ে উঠি। বছরব্যাপী নানান ভিন্ন সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতির চর্চায় বিভোর সময় পার করি। আমাদের অনাদর ও অবহেলায় মৃৎশিল্প, তাৎশিল্প, হস্তশিল্প অনেকটা বিলুপ্তির পথে। ধীরে ধীরে আমরা পশ্চিমা সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। এভাবে চলতে থাকলে বাঙালির হাজার বছরের গৌরবময় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি অদূর ভবিষ্যতে অপসংস্কৃতির আড়ালে হারিয়ে যাবে।
তাই বাঙালি সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে অপসংস্কৃতির বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে একদিনের জন্য বাঙালি না হয়ে বছরব্যাপী বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি ভাবে নানান উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে অপসংস্কৃতি চর্চাকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। এছাড়াও বাঙালি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। পরবর্তী প্রজন্মকে সুস্থ, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি চর্চা শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্যকে বাঁচানো সম্ভব।
নাঈমা আক্তার রিতা
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
নতুনত্বের সূচনায় সার্বজনীন লোকউৎসব হচ্ছে নববর্ষ। বাংলা সনের প্রথম দিনটি হচ্ছে আমাদের ধর্ম, বর্ণ ভূলে বাঙ্গালী হওয়ার দিন। এটি এমন একটি দিন, যে দিনে বাঙ্গালীরা বাঙালিয়ানায় কার্পণ্য করেনা। একটি মুসলিম পরিবারে যেমন থাকে সাজ-সাজ রব, নতুনকে বরণ করার প্রফুল্ল হৃদয়, তেমনি একটি হিন্দু,বৌদ্ধ কিংবা খ্রিষ্টান পরিবারেও থাকে একই ধরনের আমেজ। দেশের সব প্রান্তের সব মানুষের মন যেনো মিশে একাকার হয়ে যায়।
সবাই মন-প্রাণ দিয়ে চায় একটা সুন্দর ভবিষ্যতের আগমন হোক। অতীতের যতোসব না পাওয়া, পাওয়া হোক। যতোসব অভিমান মুছে যাক। যা কিছু হারিয়েছে, চলে যাক। কেবল সামনে কিছু সুন্দর দিন আসুক।
অতীতকে ঝেড়ে ফেলে নতুনত্বকে বরণ করাটা আবার একেক শ্রেণির মানুষের কাছে একেকরকম। সেটা ব্যবসায়ীর কাছে হালখাতার অদলবদল। গৃহিণীর নিকট গৃহসজ্জা, খাবারের পদে পরিবর্তন। তরুণীর কাছে সাদা পাড়ের লালশাড়ি কিংবা তরুণের নিকট গাঢ় পাঞ্জাবি অথবা সদ্য কথা বলতে শেখা বালকের নতুন খেলনা।
সে যাই হোক, পয়লা বৈশাখ আপন নিয়মে আসবেই। সে লকডাউন চেনেনা, চেনেনা কোভিড-১৯। করোনা ভাইরাস স্বাভাবিক জনজীবনে যে অস্বাভাবিকতার সৃষ্টি করেছে তার দায় ও শেষ পর্যন্ত মানুষকে বইতে হচ্ছে। সুতরাং একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমাদের সবকিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। এবার রমনার বটমূলে বাজবেনা ছায়ানটের সুর। যুবার কন্ঠে আন্দোলিত হবেনা মঙ্গল শোভাযাত্রার আলো জ্বালাবার প্রত্যাশা। তবে কি নববর্ষ উদযাপিত হবেনা?
হবে। সেটা একান্তই পারিবারিক। হয়তো প্রতিদিনকার চেয়ে একটু ভিন্ন হবে। ঘরটা নতুন সাজে সাজবে, খাবারে কিছু নতুন আইটেম যোগ হবে। টেবিলে পান্তা ইলিশ দেখেই স্মৃতিচারণে মনোযোগী হবে বৃদ্ধা। সেই সুস্থ সুন্দর বৈশাখ উদযাপনের কথা মনে পড়বে। এবং তা মুগ্ধ হয়ে শুনবে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। আর দুহাত তুলে দোয়া করবে খোদার নিকট। যেনো এই দূর্যোগের শীঘ্রই পরিসমাপ্তি হয়।
দিলুয়ারা আক্তার ভাবনা
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাঙ্গালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ ১৪২৮। প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস বৈশাখের প্রথম দিনটি বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ হিসেবে পালন করা হয়। এদিনটি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে পালন করা হয় বাঙ্গালির প্রাণের দিনটি। নতুন পোশাক, খাওয়া দাওয়া, আড্ডা, বাংলা গান, বিভিন্ন সাহিত্য উৎসবের মাধ্যমে এ দিনটিতে আনন্দে মেতে উঠে পুরো বাঙ্গালি জাতি।
বাঙ্গালির এদিনটি যে কেবল আনন্দের তা নয়, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙ্গালি যে পরস্পর প্রাণের জাতি একথাও স্বরণ করিয়ে দেয়। সেই সাথে এদেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের যেন তুলে ধরে পহেলা বৈশাখ।
“মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা….
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।”
বছরের প্রথম দিনে কবিগুরুর এমন আকুতি যেন আমাদের বাঙালি সত্ত্বাকে প্রতিবছর নিয়ে যায় ঐতিহ্যের দিকে। এদিন যেন বাঙালিকে পেছনে ফেলে আসা শোক, দুঃখ, হতাশা সবকিছু ভুলে এক কাতারে দাড়িয়ে প্রত্যাশা করে আসন্ন বছর যেন হয় সুখের, সব কিছু যেন হয় কল্যাণময়।
বর্তমান সামাজিক অবকাঠামোর পরিবর্তন, প্রযুক্তির অতিমাত্রায় অপব্যবহার, পশ্চিমা সংস্কৃতির মিশ্রণ বিভিন্ন কারনে আজ হুমকির মুখে আমাদের সংস্কৃতি। বাংলা সংস্কৃতি, ঐতিহ্য চর্চা থেকে দূরে সরে যেন না যায় আমাদের তরুণ প্রজন্ম। নববর্ষের প্রথম দিনের মত সারাবছর তরুন প্রজন্ম যেন তুলে ধরে তাদের প্রাণের সংস্কৃতি। তরুণ প্রজন্ম যেন বাংলায় ভালো করে কথা বলে, বাংলা উচ্চারণ ভালো জানে, বাংলা গান শোনে, তাদের পোশাকে যেন দেশের সংস্কৃতি ছোঁয়া দেখা যায়, পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত না হয়ে তরুণদের দেশি সংস্কৃতিতে বন্দনা বাঙালিয়ানা উৎসবে পরিনত হোক, এটাই যেন হয় প্রাণের নববর্ষের শিক্ষা, কেবল একদিনের জন্যই যেন আমরা সবাই মনে প্রাণে বাঙালি না হই।
পহেলা বৈশাখকে বুকে ধারণ করে, এদেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে এদেশের সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা থেকে তরুণ প্রজন্ম ও সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে বাংলা ভাষায় বিকাশ, বাংলার সংস্কৃতি বিকাশে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলা সংস্কৃতিকে তরুণ প্রজন্মের কাছে বারবার তুলে ধরতে হবে। বাংলাকে সাজাতে হবে আর এখান থেকেই বীজ বপণ করতে হবে বাংলার সংস্কৃতিকে ভালোবাসার। তবেই প্রকৃত প্রাণের স্পন্দন মেলানো যাবে প্রাণের মেলায়। এবারে প্রাণের মেলা হোক নিরাপত্তার, হোক কল্যাণময়।
তাসলিমা আক্তার লিমু
শিক্ষার্থী, কলেজ অফ হোম ইকোনমিক্স