খবর ৭১: ‘আইলো আইলো আইলোরে রঙে ভরা বৈশাখ আবার আইলোরে’- বৈশাখের চিরচেনা এই গানের মধ্য দিয়ে হাজির হয়েছে বাংলা বর্ষের নতুন বছর ১৪২৮। বাংলা সনের প্রথম দিনটি হচ্ছে পহেলা বৈশাখ। এ দিনটি বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। পহেলা বৈশাখ বাঙালির একটি সর্বজনীন লোকউৎসব। এ দিনটি পৃথিবীর সকল বাঙ্গালিদের ঐতিহা ও সংস্কৃতির অংশ। ঐতিহ্যবাহী দিনটি সারাদেশে উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হয়। বাঙালিরা এ দিনে পুরনো বছরের ব্যর্থতা, নৈরাশ্য, ক্লেদ-গ্লানি ভুলে গিয়ে নতুন বছরকে মহানন্দে বরণ করে নেয়, সমৃদ্ধি ও সুখময় জীবন প্রাপ্তির প্রত্যাশায়।
‘বৈশাখ’ শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে আসে বৈশাখী মেলার বর্ণিল আয়োজন, বিভিন্ন স্বাদের খাবার-দাবার এবং উৎসবমুখর একটি দিন। বৈশাখ মানেই পান্তাভাত ও ইলিশ ভাজা, মেলায় ঘুরতে যাওয়া আর হালখাতার প্রচলন তো আছেই। বাঙালীর নববর্ষ উদযাপন পুরো দেশজুড়ে হয়ে থাকে। নেই কোন ধর্মীয় ভেদাভেদ। বরং এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন লোকউৎসব হিসেবেও বিবেচিত। তবে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে বৈশাখ মানেই নতুন কাপড় কেনা, হোটেল বা রেস্টুরেন্টে খাবারের পরিকল্পনা করা। আজকাল আর সেই পুরনো ঐতিহ্যের বিষয়গুলো তেমন চোখে পড়ে না। ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যদি নববর্ষ পালন করা হয় তবে তা অনেক বেশি অর্থবহ ও আনন্দদায়ক হবে। তবে দিনটি নিয়ে সকলের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা ভিন্ন হলেও প্রত্যেকের চাওয়া রঙিন বৈশাখের আনন্দ-উদযাপনটা যেন স্মরণীয় হয়ে থাকে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ (বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ) বাংলা সনের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নিয়ে থাকে। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন লােকউৎসব হিসাবে বিবেচিত। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ ই এপ্রিল ক্ষেত্র বিশেষে ১৫ ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালন করা হয়। হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশােধ করতে বাধ্য করতে হত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ ই মার্চ বা ১১ ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরােহণের সময় (৫ ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। সেই পহেলা বৈশাখের সাথে কালের রুপান্তরে যােগ হয় রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ, মঙ্গল শােভাযাত্রা, হালখাতা, পান্তা ও ইলিশ খাওয়ার প্রথা, নৌকাবাইচ, বউমেলা, ঘােড়ামেলা ইত্যাদি। বর্তমানে পহেলা বৈশাখ কে ঘিরে আগের থেকেই শুরু হয় বাঙালিয়ানার রঙ্গে রাঙ্গার জন্য নানা রকম জল্পনা কল্পনা। আগেভাগেই বাঙালি মন প্রস্তুত থাকে পাঞ্জাবি ও পায়জামা, সাদা শাড়ি লালা পাড় সহ নানা রকম আয়ােজনে নতুন বছরকে স্বাগতম জানায়।
আমাদের দেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রবল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে দিনটি পালিত হয়। দিনটি ভালােভাবে উপভােগ করার জন্য নানা উৎসব, খেলা, প্রদর্শনী, সাংস্কৃতিক প্রভিতী অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। পারিবারিক জীবনে বিশেষ খাবারের আয়ােজন করা হয়, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সহ সকল কে আমন্ত্রিত করা হয়। এই দিনে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে হালখাতার অনুষ্ঠান পালিত করা হয়। পুরনাে হিসাব শেষ করে নতুন হিসাবের খাতা খােলা হয়। এই দিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও অনুষ্ঠান পালিত করা হয়। তরুণ তরুণী চিরাচরিত বাঙ্গালির পােষাক পায়জামা পাঞ্জাবী ও মেয়েরা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি ও ব্লাউজ পড়ে এ অনুষ্ঠানে যােগ দেয়। পহেলা বৈশাখে গ্রামবাংলার বিভিন্ন জায়গায় বৈশাখী মেলার আয়ােজনও করা হয়ে থাকে। নানা ধরনের জিনিসের সমাহার ও আনন্দ-কোলাহলে মুখরিত হয়ে ওঠে বৈশাখী মেলা। বৈশাখী মেলা হলাে সেই মেলা যা বাংলা বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখের আগমনকে অভিবাদন জানানাের জন্য উদ্যাপন করা হয়। ইহা বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশের লােকেরা বাংলা নববর্ষ উদযাপনে অভ্যস্ত। আমরা রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক বাংলা গান, “এসাে হে বৈশাখ, এসাে এসাে” গানটি গেয়ে দিনটিকে স্বাগত জানাই। যুবক, বৃদ্ধা এবং শিশুরা মেলা পরিদর্শন করে এবং বিভিন্ন জিনিস যেমন মাটির জিনিসপত্র, ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পজাত দ্রব্য, বাঁশের বাঁশি অত্যন্ত উৎসাহের সাথে ক্রয় করে। এগুলাে ছাড়াও লােকে বিশেষ আকর্ষণ হিসাবে সার্কাস, নাগরদোলা এবং যাত্রা উপভােগ করে। আগে দু-তিন গ্রামের সীমান্তবর্তী স্থানে, অথবা নদীর ধারে, বটতলায় বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হতো। এসব মেলায় নামতো হাজার হাজার মানুষের ঢল। মেলায় থাকতো কাঁচের চুড়ি, রঙ-বেরঙের ফিতা, তাঁতের শাড়ি, নকশা করা হাতপাখা, কামার ও কুমোরের দোকান, মুড়ি-মুড়কি-খই, সন্দেশ, বাতাসা, মিষ্টি, মাটির তৈরি খেলনা, পুতুল, ঘুড়ি, নাটাই, গুলতি, অলংকার, তৈজসপত্র, বেলুন, বাঁশি, ফলমূল ইত্যাদি। আর বিনোদনের জন্যে থাকতো নাগরদোলা, বায়োস্কোপ, জারি-সারি-ভাটিয়ালি গানের আসর, কবিগান, ষাড়ের লড়াই, লাঠিখেলা, পুতুল নাচ, নৌকা বাইচ, কুস্তি খেলা ইত্যাদি। কোথাও কোথাও বসতো জুয়ার আসরও! কখনাে কখনাে অনৈতিকতা এবং দুর্বল প্রশাসনের কারণে জুয়া এবং নগ্নতা মেলাকে ব্যাহত করে। বৈশাখী মেলার শিশু-কিশোরদের প্রধান আকর্ষণ ছিলো নাগরদোলা ও বায়োস্কোপ। নাগরদোলার প্রচলন এখনো টিকে থাকলেও বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে বায়োস্কোপকে এখন আর দেখা যায় না।
পহেলা বৈশাখ ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে দীর্ঘদিন ধরেই বাঙালির প্রাণের উৎসব হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। নানা প্রতিকূলতায়ও বাঙালিরা এ মেলা উদযাপন করেছে, আনন্দ-উল্লাস করে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছি। কিন্তু এখনো কিছু মানুষ বৈশাখী মেলাকে ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে বিচার করতে চান। এ বিচার বিবেচনা কেবল বাংলাদেশ রাষ্ট্র হবার পরে নয়, আগেও করা হয়েছিলো। কিন্তু প্রাণের উৎসব থেমে থাকেনি। কারো ‘হিন্দুয়ানি’ অনুষ্ঠান বলায় পহেলা বৈশাখ উদযাপন বন্ধ হয়ে যায়নি। পহেলা বৈশাখ উদযাপনে আমাদের জাতীয় চেতনা ও ঐতিহ্যের সামগ্রিক প্রতিচ্ছবির দেখা মেলে। একদিকে যেমন উৎসবে মেতে ওঠে নবীন-প্রবীণ, শিশু ও কিশোররা; অন্যদিকে নিজস্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্মও পরিমার্জিত ধারণা লাভ করতে পারে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে বাঙালির যে হাজার বছরের ঐতিহ্য তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ধারণ ও লালন করা সহজতর হবে। তবে বৈশাখী মেলার নামে অপসংস্কৃতি চর্চা কারোই কাম্য নয়। শিকড়সম্বলিত আত্মার টান, উৎসবের মুখরতায় আমাদের ঐতিহ্যের যথাযথ চর্চা ও উদযাপন হবে— এমন প্রত্যাশাটুকু থাকবে সচেতন বাঙালিদের, এটাই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকত্ব বজায় রেখে জাতিগত চেতনায় ঋদ্ধ হয়ে, সম্প্রীতি-বন্ধন অটটু রেখে বাংলাদেশকে নিয়ে এগিয়ে যাবার দায়িত্ব আমাদের সবার। নববর্ষ আমাদের জীবনে পরম আনন্দের উৎসব। এটি জীবনকে নতুন করে উপলব্ধি করার দিন। জাতীয় জীবনেও নববর্ষের তাৎপর্যকে ছড়িয়ে দিতে হবে। পহেলা বৈশাখ সবার মাঝে নতুন উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করুক আর তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এটিকে ধারণ করুক বাংলা নববর্ষে এমনটাই প্রত্যাশা।
লেখক:
মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়