খবর৭১ঃ বিভিন্ন স্থানে ৪ এপ্রিল রাতে আচমকা গরম বাতাসে কৃষকের আবাদ করা ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ধানের শীষ শুকিয়ে চিটা হয়ে গেছে। এছাড়া গরম বাতাসে ধান গাছ পুড়ে ধূসর রং ধারণ করছে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক। এ অবস্থায় ধান খেতে কৃষকের আহাজারি যেন থামছে না। যুগান্তর প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
চিতলমারী (বাগেরহাট) : বাগেরহাটের চিতলমারীর ৭টি ইউনিয়নে হিটশকে ২শ হেক্টর জমির ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে বাস্তবে ক্ষতির পরিমাণ এর দ্বিগুণ বলে দাবি করেছেন স্থানীয় কৃষকরা। চিতলমারী সদর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ নিজাম উদ্দিন বলেন, আমাদের এলাকার মানুষের জীবন জীবিকা ধান ও সবজির উপর। করোনার কারণে এমনিতেই মানুষ নানা সংকটে রয়েছে। এর মধ্যে হঠাৎ ঝড়ে অনেক কৃষকের ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। চিতলমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঋতুরাজ সরকার বলেন, চিতলমারী উপজেলায় ১১ হাজার ৭০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবদ হয়েছে। হিটশকে ২শ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। তবে কৃষকদের দাবি ক্ষতির পরিমাণ দ্বিগুণ হবে।
ভালুকা (ময়মনসিংহ) : ভালুকা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, গরম হাওয়ার কারণে এ উপজেলার ১শ পঞ্চাশ হেক্টর জমির ধানের ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। মাত্র কয়েক দিন পরেই কৃষকদের ঘরে বোরো ফসল উঠার কথা। এর মাঝে এভাবে ধান ক্ষেত পুড়ে যাওয়ায় এতে কৃষকদের মাঝে চরম হতাশা দেখা দিয়েছে। গরম হাওয়ায় মল্লিকবাড়ি, ডাকাতিয়া, কাচিনা, ধীতপুর, বিরুনীয়া, উথুরা, রাজৈ ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় বোরো ধানে চিটা হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। টুংরাপাড়া গ্রামে গেলে কৃষক সাইদুল সরকার জানান, তার দেড় একর জমির বোরো ধান সম্পূর্ণ চিটা হয়ে গেছে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা নারগিস আক্তার জানান, ৪ এপ্রিল সন্ধ্যা ৬টার দিকে উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া গরম বাতাসের কারণে সব এলাকাতেই বোরো ধানের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। এলাকা হতে তথ্য সংগ্রহ করে দেখা গেছে প্রায় দেড়শ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাধবপুর (হবিগঞ্জ) : মাধবপুরে গরম বাতাসে কৃষকের ক্ষেতের ধান চিটা হয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ধান ক্ষেতে কৃষকের আহাজারি থামছে না। উপজেলার প্রায় সব ইউনিয়নের বোরো মাঠের জমিতে সাম্প্রতিক সময়ে ধানগুলো জ্বলসে গিয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কৃষি বিভাগের দাবি অতিরিক্ত তাপমাত্রায়সহ কয়েকদিন আগের ঝড়ো বাতাসের কারণে ব্রি-২৮, ব্রি -২৯ এবং ৫৮ জাতের ধানের এ ধরনের ক্ষতি হয়েছে। কদিন পড়েই ধান কাটার কথা। কিন্তু ধানের শীষে ধানের পরিবর্তে চিটা হয়ে ধান ক্ষেত সাদা হয়ে গেছে। মাধবপুর উপজেলা কৃষি বিভাগের সূত্র মতে, এ বছর মাধবপুরে ১১টি ইউনিয়নে ১১ হাজার ৫শ ৭০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ করা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৬০ হাজার টন। কিন্তু সাম্প্রতিকালে তাপদাহ ও গরম বাতাসের কারণে এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। আন্দিউড়া ইউনিয়নের বাকসাইর গ্রামের কৃষক প্রবীর দাশ জানান, তিনি এ বছর ১০ বিঘা জমিতে ব্রি-২৮ জাতের ধান চাষাবাদ করেছেন। কিন্তু সব ক্ষেতেই এখন সাদা হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা আগে কখনো দেখিনি।
দুর্গাপুর (নেত্রকোনা) : গাওকান্দিয়া, কুল্লাগড়া, দুর্গাপুর, কাকৈরগড়া, চন্ডিগড়, বিরিশিরি, ইউনিয়নের বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, মাঠে বোরো ধানের বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু গরম বাতাসে ধানের শীষগুলো সাদা হয়ে গেছে। এতে আটাশ জাত ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। হতাশায় পড়েছে কৃষকরা। কুল্লাগড়া ইউনিয়নের কামারখালী গ্রামের আদিবাসী কৃষক কোয়েল বলেন, ‘জীবনেও আমি এমন গরম বাতাস দেখিনাই। সকালে উঠে দেখি ক্ষেতের ধান সব মরে গেছে। আমরা কী খেয়ে বাঁচব, আমাদের তো কৃষি ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। উপজেলা কৃষি অফিসার মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, অত্র উপজেলায় প্রায় ১হাজার ৫শত হেক্টরের মতো ধান নষ্ট হয়ে গেছে।
গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) : গৌরীপুর উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে গরম বাতাসে ১ হাজার ৫৬৭ জন কৃষকের সোনালি ফসল পুড়ে গেছে। সোনালি ধানের সবুজ রঙের ২শ হেক্টর আক্রান্ত জমি এখন কালচে-লালচে, আক্রান্তের পরিমাণও দিন দিন বাড়ছে। এ তথ্য নিশ্চিত করেন উপজেলা কৃষি অফিসার লুৎফুন্নাহার। তিনি জানান, হিটস্ট্রোকের কারণে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ক্ষেতের শুধু ধান নয়; শাক-সবজি জমিও পুড়ে গেছে। ধানের নির্ধারিত তাপমাত্রার চেয়ে অসহনীয় তাপমাত্রার কারণে ধানের শীষ পুড়ে গেছে। রামকৃষ্ণপুর গ্রামের কৃষক খোরশেদ আলীর বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই করছে। তিনি বলেন, আমার জীবনে এমন গরম বাতাস আর দেখি নাই। ধানের ক্ষেতও পুড়ে যায়! সব ধুসনা (চিটা) হয়ে গেছে, সব ধুসনা। আমরা ধ্বংস হয়ে গেছি।’ উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, আক্রান্তের দিক দিয়ে সর্বোচ্চ উপজেলার মাওহা ইউনিয়নে ৬০ হেক্টর, সর্বনিু ২নং গৌরীপুর ইউনিয়নে ১০ হেক্টর আক্রান্ত। এছাড়াও সহনাটী ইউনিয়নের ৫০ হেক্টর, রামগোপালপুর ইউনিয়নে ৪০ হেক্টর, অচিন্তপুর ইউনিয়নে ৩০ হেক্টর ও ডৌহাখলা ইউনিয়নে ২০ হেক্টর।
আগৈলঝাড়া (বরিশাল) : কৃষকরা জানান, জমির ধান গাছে মাত্র শীষ বের হওয়ায় গরম বাতাসে তা পুড়ে ধূসর রংয়ের হয়ে গেছে। জমিতে গিয়ে ধানের এমন অবস্থা দেখে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে কৃষকেদের। উপজেলা কৃষি সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ৫টি ইউনিয়নে ৯ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। এসব জমিতে ধানের ফ্লাওয়ারিং স্টেজ চলছে। উপজেলার বাশাইল গ্রামের কৃষক বিনোদ দাস জানান, কয়েকদিনে প্রচণ্ড গরম ও সোমবার রাতে বাতাসে ক্ষেতের আঁধা পাকা ধান পড়ে গেছে। আবার অনেক জমির ধান গাছ দাঁড়িয়ে থাকলেও তাতে কোন শীর্ষ নেই। গাছ পাতা পুড়ে গিয়ে ধূসর বর্ণের হয়ে গেছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দোলন চন্দ্র রায় বলেন, প্রায় ১৫০ হেক্টর জমির ধান আশিংক নষ্ট হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা প্রস্তুতির কাজ চলছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
ধোবাউড়া (ময়মনসিংহ) : উপজেলার কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ধোবাউড়ার ৭টি ইউনিয়নে ১৪ হাজার ৮০ হেক্টর বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে। সরেজমিন বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,আবাদকৃত জমির প্রায় ২৫ ভাগই ব্লাষ্টে আক্রান্ত। কৃষি নির্ভর উপজেলা হওয়ায় বেশিরভাগ কৃষক ফসলের উপর নির্ভর করে জীবনযাপন করেন। অনেক কৃষকই ঋণ করে ধান আবাদ করে থাকেন। বোরো ধানে হঠাৎ ব্লাষ্টে আক্রান্ত হওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষক। অনেকে ধান ক্ষেতের পাশে বসে কান্না করছেন।
শেরপুর : জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ ড. মোহিত কুমার দে জানান, ‘হিট ইনজুরিতে’ আক্রান্ত হয়ে আনুমানিক সাড়ে ৪শ’ হেক্টর জমির বোরো ধানের প্রস্ফুটিত শীষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চিটা হয়ে গেছে।’ শেরপুর সদর উপজলার খুজিউরার কৃষক জাহিদুল ইসলাম বলেন, গরম বাতাস যেদিক যেদিক দিয়া গেছে ওই দিক দিয়া সব ধান জ্বইলা গেছে গা। যে ধান ডা বাড়াইছে দেহা গেতাছে সবুজ কালারের মধ্যে একটাও চাইল নাই। খালি চুচা। আর কত্তুডি মরইরা সাদা অইয়া যাইতাছে। কৃষক ফেরদৌস বলেন, গরম বাতাসে ধান সাদা ও চিটা হয়ে গেছে।