হঠাৎ পুড়ে গেছে হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান

0
484

খবর ৭১: দেশের হাওরাঞ্চলের নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় গত রোববার রাতে বয়ে যাওয়া আচমকা গরম বাতাসে কমপক্ষে ২০ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে। তবে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া জমির পরিমাণ আরো কয়েকগুণ হবে। ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে (একেক এলাকা এক সময়) রাত ১১টা পর্যন্ত হঠাৎ বয়ে যাওয়া গরম বাতাসে ওইসব এলাকায় বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ধানের ক্ষেত পুড়েও গেছে। এতে নিঃশ হয়ে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট কৃষকেরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, পরশু দিন রাতে হঠাৎ গরম বাতাস বয়ে যায়। যেসব ধানক্ষেতে ফুল আসছে, যেখান দিয়ে বাতাস বয়ে গেছে সে জায়গায় ধানের ফুলের রেণুটা পুড়ে গেছে। যার ফলে পরাগায়ন আর হবে না।

তিনি বলেন, জাতীয় পর্যায়ে এবার ৪৮ লাখ ৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের টার্গেট ছিল। আবাদ হয়েছে ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ ৭৮ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ বেশি হয়েছে। সুতরাং এই ক্ষতি সামগ্রিকভাবে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তায় কোনো প্রভাব পড়বে না। গতবারের চেয়ে এবার ফলন আরো ভাল হবে আশা করি। কিন্তু যেসব কৃষকের ক্ষতি হলো এটাই বিষয়। আর যদি কোনো দুর্যোগ না হয়। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবো ইনশা আল্লাহ। স্থানীয়রা এটিকে লু হাওয়া বললেও আবহাওয়াবিদরা বলছেন, দেশে লু হাওয়া বয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

আবহাওয়া অধিদফতরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, বাংলাদেশে এখন যে তাপমাত্রা রয়েছে, তাতে লু হাওয়া বয়ে যাওয়ার মতো কোনো অবস্থা নেই। লু হাওয়া বা গরম বাতাস বয়ে যেতে হলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি হতে হবে। দেশে এখন পর্যন্ত লু হাওয়া বয়ে যাওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। এগুলো হলে ছোট এলাকায় হয়, স্থানীয়ভাবে। তবে তাপমাত্রা বেশি থাকলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। এখন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস আবার গত দুইদিন ঝড় বৃষ্টি হয়েছে। তাই এটা সম্ভব না। এটাকে লু হাওয়া বলা যাবে কিনা-জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: আসাদুল্লাহ ‘আপনি বলতে পারেন যে, কিছুক্ষণ গরম বাতাস বয়ে যাওয়ায় যেসব জায়গায় ধানের ফুল অবস্থায় ছিল, সেই জায়গায় কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’

কৃষক পালন মিয়া জানান, বছরের একমাত্র ফসল ধান চাষের ওপর নির্ভর করেই সারা বছর চলে তার পরিবার। কিন্তু এইবার সব শেষ হয়ে গেছে। রায়টুটী এলাকার তলার হাওরে ১২ একর জমি আবাদ করেছিলেন কৃষক আ: হেকিম।
তিনি বলেন, ‘গত বছর ধানের দাম বেশি পাইছি, হের লাইগ্যা এইবার আরো বেশি কইরে জমি করছি। জমির মইধ্যে ফসলও অইছিন বালা। কিন্তু গত রাইতেই ১০ মিনিডের একটা গরম বাতাসে সব পুইড়ে ছারকার কইরে দিসে। আমার সত্তর বছর বয়সে এই যাইত্তে বাতাস আমি জীবনেও দেখছি না। সহালে ঘুমেত্তে উইট্টে জমিতে গিয়া দেহি সব শেষ। ঋণ কইরে জমি করছিলাম। অহন পুলাপান লইয়াই কেমনে চলমু আর ঋণ কেমনে পরিশোধ করমু এই চিন্তায় আর বালা লাগতাছে না।’
একই এলাকার কৃষক মতি মিয়া বলেন, ‘গতকাইল বিহালেও জমির ফসল দেইখ্যা মনডার মাঝে আনন্দ আছিন। সকালে জমিত গিয়া ফসলের এই অবস্থাডা দেইখ্যা কইলজাডা ফাইট্টে গেছেগা। জমিতে আর যাইতাম না নিয়ত করছিলাম। অহন আফনেরা আইছুইন, হের লাইগ্যা জমিডার ক্ষতি দেহাইতাম আইছি। আমরার আর যাওয়ার জায়গা নাই। এই করোনার মাইঝে অহন তো ডাহা গিয়াও কিছু কইরে খাইতাম ফারতাম না।’
জেলার ১৩টি উপজেলার হাওরে মাত্র ১০ মিনিটের গরম বাতাসে প্রায় ২৬ হাজার হেক্টর জমির ধান পুড়ে গেছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বোরো ধানের জমি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে তিন হাজার ৪২৫ হেক্টর জমির। আর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২২ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমির ধান।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ছাইফুল আলম জানান, বৃষ্টিবিহীন ঝড়ো বাতাসে এই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। হাওরের ধানের গাছগুলো এখন মিল্কিং স্টেজে (দুধ অবস্থায়) আছে। এই সময়ে প্রায় ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার গরম বাতাসে ধান পুড়ে চিটা হয়ে গেছে।
কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক বলেন, ‘আমি কৃষি বিভাগকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছি। তালিকা হাতে পেলে সহায়তা চেয়ে মন্ত্রণালয়ে লিখিত পাঠানো হবে।’

ধানের ক্ষেত নষ্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া ও কাশিয়ানীতে : এক রাতের মধ্যে শত শত হেক্টর জমির ধান সবুজ থেকে সাদা বর্ণ ধারণ করেছে। কৃষি বিভাগ বলছে, লু হাওয়ার কারণে চাষিরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। গত রোববার রাত সাড়ে ১১টার দিকে কোটালীপাড়া উপজেলার ওপর দিয়ে গরম হাওয়া বয়ে যায়। এতে উপজেলার কান্দি, পিঞ্জুরী, হিরণ ও আমতলী ইউনিয়নের প্রায় ছয় থেকে ৭০০ হেক্টর জমির বোরো ধান নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here