রাকিব হাসান পটুয়াখালীঃ
ক্যান্সারে আক্রান্ত ষাটর্ধো স্ত্রী হাচন বানুকে নিয়ে পচাঁত্তরোর্ধ চাঁন মিয়া হাওলাদার আশ্রয় নিয়েছেন রাবনা নদের পাড়ের বেরিবাঁধের ঢালে নড়বড়ে ঝুপড়ি ঘরে। খেয়ে না খেয়ে চলছে পুত্র সন্তানহীন এ দম্পত্তির জীবন সায়হ্নাহের শেষ সময়। পায়রা বন্দরের ভ’মি অধিগ্রহনে বসতভিটা, আবাদি জমিসহ ১২ একর জমি হারিয়ে এখানে হয়েছে তাদের আশ্রয়। বসতঘরের ক্ষতিপুরনের টাকা পেলেও এখনো কপালে জোটেনি জমির মূল্য। মেলেনি ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য র্নির্মিত আবাসনে পুর্নবাসনের ঘর। জীবদশায় জমির মূল্য হাতে পাবেন এমন আশা এখন তিনি ছেড়েই দিয়েছেন। সব থাকতেও বিনা চিকিৎসায় অসুস্থ স্ত্রী মারা যাবেন এমন কস্টে নীরবে ঝড়াচ্ছেন চোখের জল।
অশ্রু সজল নয়নে চাঁন মিয়া জানান, সুন্দর, শক্তপোক্ত ঘর ছিল। পুকুর ভরা মাছ ছিল। হাঁস-মুরগী-গবাদি পশু সবই ছিল। এখন কিছুই নেই। পায়রা বন্দরের জন্য ভ’মি অধিগ্রহনে ২০২০ সালের ডিসেম্বরের আচমকা উচ্ছেদ নোটিশ হারিয়েছেন সব। বয়সের ভাড়ে নুয়ে পড়া এ মানুষটি হাউমাউ করে কেঁদে দিয়ে বলেন, ঘরের ক্ষতিপুরন বাবদ ৬ লক্ষ টাকা পেলাম। কিন্তু বালিয়াতলী ইউনিয়নের কাদের মাস্টারের পুত্র জাহিদ প্রতরনা করে ব্যাংক থেকে তুলে নিয়ে গেছে চার লক্ষ টাকা। প্রতিমাসে স্ত্রীর ঔষদের জন্য প্রয়োজন কুড়ি হাজার টাকা। এখন অন্যের সাহায্যে টেনেটুনে চলছে অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা, দু’মুঠো খাবার।
এমন চিত্র এখন পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের চাড়িপাড়া গ্রামের জেলে ও কৃষি পেশায় সম্পৃক্ত দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ৬৫ পরিবারের। বসতঘর, গাছপালা, পুকুর-ঘেরের ক্ষতিপুরন পেলেও এসব পরিবার এখনো পায়নি জমির মূল্য। মেলেনি পুর্নবাসন। ফলে অনেকেরই আশ্রয় হয়েছে প্রকল্পের পাশে বেরিবাঁধের ঢালে ছাপড়া দেয়া ঘরে। আবার কিছু পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন বানাতিবাজারের ভাড়া বাসায়।
ক্ষতিগ্রস্থ জমির মালিকরা জানান, স্থানীয় ভুমিদস্যু নাসির হাওলাদার, রাজ্জাক প্যাদা, সালেহা বেগমসহ আরো কয়েকজনের সহায়তায় জেলার গলাচিপা উপজেলার বড়বাইশদিয়া এলাকার চিহ্নিত ভূমিদস্যু মোস্তফা এই ৬৫ পরিবারের এসএ-৪৫, ৪১ ও ৮৮ খতিয়ানের ৩৬ একর জমি নিয়ে একটি মামলা দায়ের করে ক্ষতিপুরনের চেক আটকে দিয়েছেন। পটুয়াখালী ভ’মি অধিগ্রহন শাখা থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে মামলা জটিলতার নিরসন না হলে জমির টাকা তারা পাচ্ছেন না। একইভাবে পূর্নবাসন কর্তৃপক্ষও তাদের জানিয়ে দিয়েছেন জমির মূল্য প্রদানের চেকের কপি প্রদর্শন না করলে মিলছেনা আবাসনে ঘর।
সোবাহান হাওলাদার (৩০) বলেন, ভূমিদস্যু মামলাবাজ এ চক্রটি অধিগ্রহন নোটিশ প্রদানের পরই আদালতে মামলা দায়ের করেছে। আবার প্রত্যেকের বাড়ী বাড়ী গিয়ে তারা মোটা টাকা দিয়ে আপোষ মিমাংসার প্রস্তাব দিচ্ছে। যারা মামলাবাজদের চাহিদার টাকা দিচ্ছে, তারাই এলএও শাখায় গিয়ে জমির মূল্যের চেক পাচ্ছেন।
কাইয়ুম (২৮) বলেন, সংশ্লিস্ট ভ’মি অফিসের র্দুনীতিবাজ কর্মচারীদের সহায়তায় একটি জালিয়াতি চক্র ও মামলাবাজ চক্র ভ’য়া দলিল-পর্চা তৈরি করে আদালতে মামলা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এ চক্র ৪০-৬০ ভাগ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
দুই শিশু সন্তানের জননী বিধবা জোৎসনা বেগম (৩০) দ্ইু শিশু সন্তানসহ আশ্রয় নিয়েছেন বেরিবাধের ঢালে। শংকা প্রকাশ করে বলেন, বর্ষাসহ ঝড়-বন্যার মৌসুম আসছে। বাচ্চাদের নিয়ে ছাপড়া দেয়া ঘরে কিভাবে থাকব!?
কৃষি কাজ করতেন মিজান প্যাদা (৩৯)। আধিগ্রহনে বসতভিটার সাথে হারিয়েছেন চাষের সবটুকু জমি। জানান, ঘরের ক্ষতিপুরনের সামান্য টাকায় ভাড়া ঘরে থেকে সব এখন সঞ্চয় শেষ হওয়ার পথে। এখন জমির টাকাসহ পুর্নবাসন না পেলে ভিক্ষা ছাড়া উপায় নাই।
সংশ্লিস্ট ইউপি সদস্য রবিউল ইসলাম বলেন, ক্ষতিগ্রস্থ ৬৫টি পরিবার বর্তমানে মানবেতর জীবন পার করছে। ভূমিদস্যু মামলাবাজ চক্রকে জমির মালিকানার স্বপক্ষের দলিলপত্র নিয়ে বেশ কয়েকবার শালিশ বৈঠকের কথা বলা হলেও তারা এড়িয়ে যাচ্ছেন।
লালুয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শওকত হোসেন তপন বিশ্বাস বলেন, এলাকার চিহ্নিত মামলাবাজ চক্রের সদস্যদের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হলে সাধারন মানুষের ভোগান্তি কমে আসবে।জেলা প্রশাসক মো. মতিউল ইসলাম চৌধুরী বলেন, তিনগুন ক্ষতিপুরনসহ মাঠ পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্থের হাতে চেক প্রদান করা হচ্ছে। মামলাবাজ চক্রের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেলে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে।