রেদোয়ান হোসেন জনি, মিরসরাই:
করোনাকাল কঠিন এক অধ্যায়ের নাম। গত একটি বছর ছিল করোনায় মৃত্যুবরণকারীদের লাঞ্চনা-বঞ্চনা ও আলোচনা-সমালোচনার বিষয়। যা আজৌ চলমান রয়েছে। যে বাবা-মা নিজের সবটুকু বিসর্জন দিয়ে সন্তানকে মানুষ করেছেন সেই সন্তানও স্বার্থপর হয়ে দূরে ঠেলে দিয়েছেন তাদের।
এমন এক ক্রান্তিকাল পালন করছিল সারাদেশের মত মিরসরাইয়ের মানুষও। ঠিক তখনই করোনায় নিহতদের দাফন-কাফন সম্পন্ন করতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘শেষ বিদায়ের বন্ধু’র আত্মপ্রকাশ ঘটে মিরসরাইয়ে। গত বছরের ৮ এপ্রিল সূচনা হওয়া এই সংগঠনের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য করোনায় মৃত ব্যাক্তির গোসল ও দাফন-কাফন এবং আর্তমানবতার কল্যাণে কাজ করা।
মিরসরাই থেকে যাত্রা শুরু হওয়া সংগঠনটি আজ শাখা ছড়িয়েছে পার্শ্ববর্তী ৬ টি জেলা-উপজেলায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই সদর ইউনিয়নের ওয়ার্লেস এলাকায় সংগঠনটির প্রধান কার্যালয় রয়েছে। সংগঠনটির বর্তমান কার্য্যক্রমের মধ্যে রয়েছে করোনা পজেটিভ, বেওয়ারিশ এবং যেকোন মৃত ব্যাক্তির দাফন-কাফনের ব্যবস্থা, লাশ ধোয়ানোর ব্যবস্থা, ২৪ ঘন্টা এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, অক্সিজেন সার্ভিস, এতিম-দরিদ্র ও অসচ্ছলদের সহায়তা, দুর্যোগকালীন ত্রাণ সহায়তা, প্রধান কার্যালয়ে মৃত ব্যক্তির গোসলের জন্য অত্যাধুনিক গোসলখানা, ফ্রি কাফনের কাপড় বিতরণ। সংগঠন পরিচালনায় রয়েছে সর্বোচ্চ পরিষদ, স্থায়ী পরিষদ ও কার্যনির্বাহী পরিষদ। শীঘ্রই চালু হবে কবরস্থানের কার্য্যক্রমের কাজ। দ্রুত সময়ের মধ্যে কার্য্য সম্পাদন করতে ইতিমধ্যে বিভিন্ন উপজেলায় সংগঠনটির শাখা কার্যালয়ও চালু করা হয়েছে। গত ১ বছরে করোনা পজেটিভ, সাসপেক্টেড ও স্বাভাবিক মৃত্যুবরণকারী ৯০ জন ব্যক্তির দাফন-কাফন সম্পূর্ণ করে সংগঠনটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মিরসরাই উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও দুইটি পৌরসভায় ১৮টি ইউনিট রয়েছে সংগঠনটির। প্রতি ইউনিয়নে ৭ জন পুরুষ ও ৫ জন মহিলা সদস্য রয়েছে। উপজেলায় ১৮ টি ইউনিটে ২১৬ জন স্বেচ্চাসেবক কাজ করে। আলেম ওলামা দ্বারা ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে এই সংগঠন ৯০ জন মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফন সম্পন্ন করেছে। তম্মধ্যে করোনা পজেটিভ, করোনা সাসপেক্টেড, স্বাভাবিক মৃত্যুবরণকারী নারী-পুরুষ রয়েছে। চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে সংগঠনের কার্য্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে মিরসরাই ছাড়াও ফেনী, সেনবাগ, ছাগলনাইয়া, রামগড়, খাগড়াছড়িতেও। এমনও দিন ছিল রাত ৩ টায় শেষ বিদায়ের বন্ধু টিম লাশের গোসল, দাফন-কাফন করে নিজ ঘরে থাকতে পারেনি, নিজ গ্রামেও আসতে পারেনি।
একদিকে পরিবারের সুরক্ষার চিন্তা, অন্যদিকে সমাজের একশ্রেণীর মানুষের করোনার লাশ দাফনের অজুহাতে স্বপরিবারে গ্রাম ছাড়া করার হুমকি ছিল করোনা থেকেও ভয়ংকর। তবুও রাত-দিন নিস্তব্ধ জনপদে অ্যাম্বুলেন্স আর কাফনের কাপড় নিয়ে সদা প্রস্তুত থাকতো শেষ বিদায়ের বন্ধুরা। করোনায় আক্রান্ত হয়ে কোন রোগীর মৃত্যুর খবর পেলেই দাফন কাফনে ছুটে যায় সংগঠনটির সদস্যরা। সেখানে গিয়ে সম্পূর্ণ বিনা খরচে নির্ভয়ে লাশের গোসল দিয়ে খাটিয়ায় তুলে কাঁধে বহণ করে দাফন কাফন সম্পন্ন করেন। মিরসরাইয়ের ওসমানপুরের প্রবাসী ছালেহ আহমদের মৃত্যুর পর পরিবারের নিষ্ঠুরতা সারাদেশের মানুষের বিবেক নাড়া দিয়েছিল। তিনি চট্টগ্রাম শহরের বাসায় রাতে মারা যাওয়ার পর সকালে লাশ গ্রামের বাড়ি ওসমানপুরে নিয়ে আসলে লাশ এ্যাম্বুলন্সে থেকে নামার আগেই বাড়ি লোকজন ভয়ে পালিয়ে যায়। সারাদিন লাশ উঠানে রোদে শুকিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে।
দিন শেষে সন্ধ্যার আগে খবর পেয়ে সেই লাশ দাফন করতে ছুটে যায় শেষ বিদায়ের বন্ধুরা। শুরু থেকে করোনাকালীন মসজিদের ইমাম মোয়াজ্জিন ও নুরানী মাদ্রাসার শিক্ষকদের ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়, ১ শত হাফেজ শিক্ষার্থীকে জুব্বা ও পায়জামা দেওয়া হয়, নারীদের বোরকা প্রদান করা হয়, ক্লিফটন গ্রুপের সৌজন্যে করোনা সচেতনতায় মাস্ক ও টিশার্ট বিতরণ করা হয়, প্রিমিয়াম ট্রেড এন্ড এক্সেসরিজের সৌজন্যে শেষ বিদায়ের বন্ধু সংগঠনের লোগো সম্বলিত টিশার্ট বিতরণ করা হয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি ও মিরসরাই উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব জসিম উদ্দিনের রোগমুক্তি কামনায় উপজেলার ৫ শতাধিক মসজিদে দোয়া ও কোরআন খতম করা হয়, পরিবেশ রক্ষায় মসজিদ মাদ্রাসার শিক্ষকদের মাঝে গাছের চারা বিতরণ করা হয়, মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিনের বিদায় সংবর্ধনা ও বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিনহাজুর রহমানকে বরণ অনুষ্ঠান করা হয়। ইতিমধ্যে বেওয়ারিশ লাশ দাফনকারী সংস্থা আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম চট্টগ্রাম শাখার পরামর্শে সংগঠনের র্কায্যক্রম সময়োপযোগী করার পরকিল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
শেষ বিদায়ের বন্ধু সংগঠনের প্রধান উদ্যোক্তা মিরসরাই প্রেসক্লাবের সভাপতি নুরুল আলম জানান, ৮ এপ্রিল অস্থায়ী কার্যালয় দারুল উলুম মাদ্রাসা থেকে শুরু হয় শেষ বিদায়ের বন্ধু সংগঠনের আনুষ্ঠানিক পথচলা। জনপ্রতিনিধি, ডাক্তার, সাংবাদিক, মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষের সহযোগিতায় সংগঠনটি দ্রæত প্রাতিষ্ঠানিক রুপ লাভ করে। প্রথম বর্ষপূর্তিতে বিশেষভাবে স্মরণ করছি এই সংগঠনের সকল অর্জনের মূলে যাদের অবদান, যারা জীবনের ঝুঁকি, পরিবারের বাঁধা, সামাজিক হুমকি উপক্ষো করে দিনরাত সময়ে অসময়ে লাশের গোসল, দাফন- কাফন করেছেন। এছাড়া স্মরণ করছি দেশ-বিদেশের অসংখ্য শুভানুধ্যায়ী, দেশ-বিদেশের সকল সদস্য, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, সর্বোচ্চ পরিষদ, স্থায়ী পরিষদ ও র্কাযনির্বাহী পরিষদের সকল সদস্যদের। আরো স্মরণ করছি যারা এ্যাম্বুলেন্স, অক্সিজেন ও কবরস্থান করতে সহায়তা তহবিলে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে সংগঠনের সেবার কার্য্যক্রম ত্বরান্বিত করেছেন। যেসব শিক্ষার্থীরা তাদের মাটির ব্যাংকের সঞ্চিত টাকা, জন্মদিনের অনুষ্ঠানের টাকা মানবিক তহবিলে দিয়ে করোনাকালে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন, যেসব প্রবাসীরা এ্যাম্বলেন্স তহবিলের জন্য নিজে শ্রম দিয়ে তাদের কষ্টার্জিত টাকা কালেকশন করে পাঠিয়েছেন, সর্বোপরি এ সংগঠনের সকল কাজের দিকনির্দেশনায় যারা ছিলেন প্রধান ধর্মীয় পরামর্শক হাফেজ মাওলানা শোয়াইব, সেবা সমন্বয়ক আলহাজ্ব নিজাম উদ্দিন, সমন্বয়ক হিসাব ও অর্থ আশরাফ উদ্দিন সোহেলসহ সকলের প্রতি কৃতজ্ঞ।