করোনা পরিস্থিতির অবনতি

0
288

খবর৭১ঃ
দেশে করোনা সংক্রমণের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতিতে হাসপাতালগুলোয় কানায় কানায় রোগী ভর্তি। সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) বেড পাওয়া যাচ্ছে না। সাধারণ শয্যাও ফাঁকা নেই অধিকাংশ হাসপাতালে।

হাসপাতালে শয্যার সংকটে বিপাকে পড়েছে রোগীরা। আর আইসিইউর সংকটে বাড়ছে মৃত্যুর ঝুঁকি। আইসিইউর জন্য হাহাকার করছেন রোগীর স্বজনেরা। আইসিইউর জন্য ঘুরতে হচ্ছে হাসপাতালের পর হাসপাতাল। দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ চূড়ায় (পিক) উঠেছিল গত বছরের জুন-জুলাই মাসে। ঐ সময়টায় বিশেষ করে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জুলাই মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার রোগী শনাক্ত হতো। এমন পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘আরেকটি চূড়ার (পিক) দিকে যাচ্ছে দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি।’ গত পাঁচ দিনই দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের বেশি।

গতকাল রবিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৩ হাজার ৯০৮ জনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে; মৃত্যু হয়েছে আরো ৩৫ জনের। এর আগে গত বছরের ২ জুলাইয়ের চেয়ে বেশি রোগী শনাক্তের খবর দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেদিন মোট ৪ হাজার ১৯ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছিল।

এদিকে সরকারি হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালে বেডের চরম সংকট দেখা যাচ্ছে। গত বছর করোনা রোগী বাড়লে আইসিইউ নিয়ে হাহাকার দেখা দিয়েছিল। এবারও বদলায়নি চিত্র। অনেক জায়গায় সেন্ট্রাল অক্সিজেন দিতে বলা হয়েছিল, কিন্তু তা দেওয়া হয়নি। অ্যানেসথেসিওলজি বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলেন, ‘আইসিইউ ব্যবস্থাপনার জন্য অ্যানেসথেসিওলজিস্টের সংকট রয়েছে। লোক নিয়োগের যে প্রস্তাব দিয়েছি, তা বাস্তবায়ন হয়নি। করোনা রোগীদের জন্য সরকারি হাসপাতালে সিট বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু ডাক্তার নেই। তাহলে সিট বাড়িয়ে কী লাভ? বিএসএমএমইউর মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের একজন অধ্যাপক ১০ দিন ধরে চেষ্টা করার পর একটা আইসিইউ বেড দিতে পারেন। তাহলে সাধারণ মানুষ কীভাবে আইসিইউ বেড পাবে? রোগীকে সময়মতো আইসিইউতে নিতে পারলে অনেক রোগী ভালো হয়ে যায়।

বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকদের পরামর্শ বাস্তবায়ন করেনি মন্ত্রণালয়। কয়েক জন ডাক্তার  বলেন, বর্তমানে ডাক্তারদের ওপর হিমালয়ের পর্বতের মতো চাপ পড়েছে। কিন্তু পলিসিমেকাররা তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। করোনা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যেসব প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়, তার অধিকাংশ বাস্তবায়ন হয় না। একজন কর্মকর্তা এর সত্যতা স্বীকার করেছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী করোনা চিকিত্সাসেবা সম্প্রসারণে যে ধরনের নির্দেশনা দিয়েছেন, তা-ও সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

করোনা চিকিত্সাসেবায় নিয়োজিত বেশ কয়েক জন চিকিত্সক বলেন, ৪০ হাজার বেকার ডাক্তার আছেন। তাদের কেন দ্রুত নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না? বেকার বিপুলসংখ্যক নার্সও রয়েছেন, তাদেরও দ্রুত নিয়োগ নিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, মিছিল, মিটিং ও জনসমাবেশ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। এখনই যে অবস্থা সামাল দেওয়া কঠিন হচ্ছে, আরেকটু বাড়লে কিছুই করার থাকবে না। তাই প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধে জোর দিতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করতে হবে। এক্ষেত্রে যা করার তাই দ্রুত করা প্রয়োজন।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, করোনা যাতে না হয়, সেদিকে সবার নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানলে নিজে বাঁচবে, অন্যকেও বাঁচানো হবে। তিনি বলেন, করোনা পজিটিভ হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিত্সকের পরামর্শ নিন। শুরুতে চিকিত্সা নিলে হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। করোনা রোগীদের চিকিত্সার জন্য আগে যে চিকিত্সাব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, তা এখন আবার পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করতে হবে। আইসিইউ বাড়াতে হবে।

মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, হাসপাতালে নরমাল সিট নিয়ে হাহাকার চলছে। আর আইসিইউ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, ‘এখন একটা ভয়ংকর দিক হলো, জ্বর-কাশি নেই, কিন্তু হঠাত্ করে খারাপ অবস্থা হয়ে যাচ্ছে রোগীর। এখন আর ছোট-বড় নেই, করোনা হলে সবার অবস্থা খারাপ হয়। করোনা রোগী বৃদ্ধির যে অবস্থা, তাতে কত দিন চিকিত্সাসেবা প্রদান ধরে রাখতে পারব, তা বোধগম্য নয়। এই রোগ যাতে না হয়, সেই কাজ সবাইকে করতে হবে। অর্থাত্ সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।’

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খলিলুর রহমান বলেন, এ হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য প্রথমে ১০০ বেড চালু করা হয়েছিল। পরে ৫০টি বেড বাড়ানো হয়। তবে রোগীদের প্রচণ্ড চাপ থাকায় আরো ৫০টি বেড বাড়িয়ে এখন ২০০ করোনা রোগীকে সেবা দেওয়া হচ্ছে। করোনা রোগীদের জন্য বন্ধ হওয়া ১০ বেডের আইসিইউ পুনরায় চালু করা হচ্ছে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, ‘করোনা রোগী হু হু করে বাড়ছে। যে হারে বাড়ছে, তাতে কতক্ষণ সামাল দিতে পারব জানি না। তবে আমরা চিকিত্সাসেবা চালিয়ে যাচ্ছি।’ তিনি বলেন, মানুষকে যাতে হাসপাতালে আসতে না হয়, সেজন্য স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।

স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ বলেন, সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালে বেড খালি নেই। মিটফোর্ড হাসপাতালে কোভিড রোগীদের জন্য নতুন ইউনিট খোলা হচ্ছে। আগামী ১ এপ্রিল হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিত্সাসেবা প্রদান কার্যক্রম চালু হবে।

সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্তের হার

এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার বেড়ে ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ হয়েছে, যা ৩১ আগস্টের পর সবচেয়ে বেশি। দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৫ লাখ ৯৫ হাজার ৭১৪ জনে। আর গত এক দিনে মারা যাওয়া ৩৫ জনকে নিয়ে দেশে করোনা ভাইরাসে মোট ৮ হাজার ৯০৪ জনের মৃত্যু হলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here