মঈনুল হাসান রতন হবিগঞ্জ প্রতিনিধিঃ হবিগঞ্জের বাহুবলের আলোচিত মা-মেয়ে হত্যাকাণ্ডের ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। আদালতে দেয়া ঘাতকের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বরাত দিয়ে শনিবার রাতে প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান হবিগঞ্জের এসপি মোহাম্মদ উল্ল্যা (বিপিএম-পিপিএম)।
ঘাতক আমির হোসেন সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার সালুটিকর গ্রামের আলমগীর মিয়ার ছেলে ও অপর ঘাতক মনির মিয়া বাহুবল উপজেলার নোয়া ওই গ্রামের মহিদ উল্লার ছেলে।
এসপি জানান, বাহুবল উপজেলার পুটিজুরী ইউপির লামাপুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা সবজি ব্যবসায়ী সঞ্জিত দাশ স্ত্রী-সন্তান নিয়ে স্থানীয় দ্বিগাম্বর বাজারের আব্দুল মোমিন তালুকদারের ৩ তলা ভবনের উপরের তলায় ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করছিলেন। একই বিল্ডিংয়ের ২য় তলায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করেন ওই বাজারের সবজি শ্রমিক আমির হোসেন। একসঙ্গে থাকার সুবাদে আমির হোসেন ও সঞ্জিত দাশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। সম্প্রতি সঞ্জিত দাশের কাছ থেকে ৩ হাজার টাকা ধার নেয় আমির হোসেন। এ সময় সঞ্জিত দাশের ঘরে দু’লাখ টাকা জমা ছিল। টাকা ধার নেয়ার সময় বিষয়টি জানতে পারে আমির হোসেন। এরপর থেকেই সে ওই টাকা লুট করার পরিকল্পনা করে। এরইমধ্যে বুধবার সকালে সঞ্জিত দাশ ব্যবসায়িক কাজে সুনামগঞ্জ চলে যান। যাওয়ার সময় তার স্ত্রী-সন্তানকে খেয়াল রাখার জন্য আমির হোসেনকে বলেন তিনি। এ সুযোগে ওই টাকা লুটের পরিকল্পনা করে আমির। পরিকল্পনা অনুযায়ী নিজের স্ত্রী-সন্তানকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেয় সে। পরিকল্পনার বিষয়টি তার সহযোগী মনিরসহ আরো এক ব্যক্তিকে জানায়। ওই দিন আমির হোসেন, সঞ্জিত দাশের স্ত্রী অঞ্জলী মালাকার ও তার শিশু কন্যা পূঁজা দাশ ছাড়া পুরো বিল্ডিংয়ে আর কেউই ছিল না। বুধবার রাত সাড়ে ৩টায় পরিকল্পনা করে বিল্ডিংয়ের বিদ্যুতের মেইন সুইচের সংযোগ কেটে দেয় তারা। এ সময় অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য সঞ্জিত দাশকে ফোন করে আমির হোসেন। সঞ্জিত দাশ জানান, তিনি সুনামগঞ্জেই আছেন। আমির হোসেন তখন চুরি ঘটনার নাটক সাজায়। সে জানায়, তার বাসায় চুরি হয়েছে। আমির হোসেনের সঙ্গে কথা শেষ করে নিজের স্ত্রীকে ফোন করেন সঞ্জিত দাশ। স্ত্রী অঞ্জলী মালাকার স্বামীকে জানান, বাসায় বিদ্যুৎ নেই, তার ভয় করছে। সঞ্জিত তখন শান্তনা দিয়ে বলেন, ভয় করোনা, আমি সকালেই চলে আসছি। স্বামী-স্ত্রীর এ কথোপকথন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শুনছিল আমির হোসেন ও তার সহযোগীরা। তাদের কথা শেষ হতে না হতেই অঞ্জলীকে ফোন করে আমির হোসেন বলেন, আমার বাসা চুরি হয়েছে, বৌদি দরজাটি খুলুন। অঞ্জলী তখন দরজা খুলে দেন। এরপরই অঞ্জলীকে ঝাঁপটে ধরে আমির, মনির ও অপর সহযোগী। ছুরি দিয়ে গলাকেটে নৃশংসভাবে অঞ্জলী মালাকারকে হত্যা করে তারা। ধস্তা-ধস্তির শব্দে তার ৯ বছরের শিশু কন্যা পূঁজা দাশ জেগে উঠে চিৎকার শুরু করে। এ সময় শিশু পূঁজাকেও নির্দয় ভাবে গলাকেটে হত্যা করে ঘাতকরা। পরে ঘরে রক্ষিত ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যায় তারা। ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে আরো এক নাটক সাজায় আমির হোসেন। সে তখন অঞ্জলীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোন পার্শ্ববর্তী খালে ফেলে দেয় এবং নিজের হাত নিজেই কেটে আহত সেজে পার্শ্ববর্তী জমিতে পড়ে থাকে। বৃহস্পতিবার সকালে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। এদিকে, বৃহস্পতিবার সকালে সুনামগঞ্জ থেকে ফিরে স্ত্রী-সন্তানের রক্ত মাখা লাশ দেখতে পান সঞ্জিত দাশ। সঞ্জিত দাশের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমির হোসেনকে আটক করে পুলিশ। এরপর সঞ্জিত দাশ বাদী হয়ে বাহুবল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। ওই মামলায় আমির হোসেনকে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। পরে আমির হোসেনের দেয়া তথ্যানুযায়ী অঞ্জলী মালাকারের ব্যবহৃত মোবাইল, রক্তমাখা ছুরি ও নগদ ৮৫০ টাকা উদ্ধারসহ অপর ঘাতক মনিরকেও গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে ঘাতক আমির ও মনিরের অপর সহযোগী এখনো পলাতক রয়েছে। তাকে গ্রেফতার করতে পুলিশি অভিযান অব্যাহত আছে। ঘাতক আমির হোসেনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। অপর ঘাতক মনির মিয়াকে আজ রবিবার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হবে। লুটকৃত টাকার অবশিষ্টাংশ ও নিহত অঞ্জলী দাশ ঘটনার পূর্বে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন কিনা জানতে চাইলে এসপি জানান, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ব্যতিত ধর্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। ঘাতক আমির হোসেন জানিয়েছে লুটকৃত টাকার অবশিষ্টাংশ তার পলাতক সহযোগীর কাছে আছে। প্রেস ব্রিফিংয়ে আরো উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত এসপি মাহফুজা আক্তার শিমু, বাহুবল-নবীগঞ্জ সার্কেলের সহকারী এসপি পারভেজ আলম চৌধুরী, বাহুবল মডেল থানার ওসি মো. কামরুজ্জামান, ওসি (তদন্ত) আলমগীর কবিরসহ পুলিশ কর্মকর্তারা।