খবর৭১ঃ
শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত কাঁচামালের দাম অব্যাহতভাবে বাড়ছে। বাড়ার গতি অস্বাভাবিক। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে তুলা, স্টিল, সিমেন্টের কাঁচামাল, অপরিশোধিত তেল এবং বিভিন্ন যন্ত্রাংশ।
গত দুই মাসে কোনো কোনো পণ্যের দাম বৃদ্ধির হার প্রায় ৩০ শতাংশ। এতে বেড়ে যাচ্ছে পণ্যের উৎপাদিত খরচ, যা দেশীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে বাড়তি দামের কারণে আগে নেওয়া রপ্তানির অর্ডারগুলো সরবরাহ করা যাচ্ছে না। নতুন অর্ডারও নেওয়া যাচ্ছে না। বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বস্ত্র খাত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত দুই কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। প্রথমত, করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কাঁচামাল রপ্তানিকারকরা দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কায় চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ বিপুল পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। সামগ্রিকভাবে এতে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যে কোনো মূল্যে এর সমাধান করতে না পারলে উৎপাদনমুখী দেশীয় শিল্পে আরও বিপর্যয় নেমে আসবে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সোমবার বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ছে। এতে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। তবে এখানে স্বল্প মেয়াদে আমাদের বেশিকিছু করার নেই। কারণ বিশ্ববাজারের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই।
এক্ষেত্রে যেসব দেশ এই ধরনের কাঁচামাল রপ্তানি করছে, তাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তিতে দরকষাকষির মাধ্যমে দাম কিছুটা কমানো যায় কি না, সেটি চেষ্টা করা যেতে পারে। তবে মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদে কিছু উদ্যোগ নেওয়া যায়। যেমন: শিল্পে ব্যবহার হয়, এমন কিছু কাঁচামাল দেশেও উৎপাদন করা সম্ভব। সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া উচিত। অর্থাৎ ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বাড়াতে সরকারকেও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
জানা গেছে, দেশের অর্থনীতিতে শিল্প খাতের অবদান বাড়ছে। বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) শিল্পের অবদান ২৯ শতাংশ। কর্মসংস্থানেও সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে এ খাত। কিন্তু প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তার অভাবে এ খাতের কাঙ্ক্ষিত সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে শিল্পে ব্যবহৃত বেশির ভাগ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু বর্তমানে এই কাঁচামালের দাম অব্যাহতভাবে বাড়ছে।
দেশের অন্যতম প্রধান খাত বস্ত্র। এ খাতের প্রধান কাঁচামাল তুলা। গত বছরের শুরুতে কিছুটা কমতে থাকে তুলার দাম। কিন্তু জুলাইয়ের পর আবারও বাড়তে থাকে। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি পাউন্ড তুলার দাম ছিল ৬৩ থেকে ৬৩ দশমিক ৩০ সেন্ট। বর্তমানে প্রতি পাউন্ড তুলা বিক্রি হচ্ছে ৭৯ থেকে ৮০ দশমিক ২৫ সেন্টে। এ হিসাবে মূল্যবৃদ্ধির হার সাড়ে ২৮ শতাংশের বেশি। মূলত চীনা কারখানার মালিকদের অতিরিক্ত আমদানির কারণে তুলার দাম বেড়েছে বলে স্থানীয় সূত্র জানায়।
দাম আরও বাড়তে পারে-এমন আশঙ্কায় চীনা আমদানিকারকরা এবার অতিরিক্ত তুলা মজুত করেছেন। এছাড়া পাকিস্তান এবং অন্যান্য কয়েকটি দেশে তুলার উৎপাদন কম হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে। তুলার দাম বেড়ে যাওয়ায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুতার দামও বেড়েছে। উৎপাদকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩০ কার্ডেড সুতা কয়েক মাস আগে প্রতি কেজি ২ ডলার ৬০ সেন্ট থেকে ২ ডলার ৮০ সেন্টে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখন এটি বিক্রি হচ্ছে ৩ দশমিক ৬০ থেকে ৩ দশমিক ৭৫ সেন্টে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার মেনুফ্যাকচারিং অ্যান্ড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সোমবার যুগান্তরকে বলেন, শিল্পের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিতে আমরা অত্যন্ত বিপাকে। বিশেষ করে সুতার দাম অনেক বেশি বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, দেড় মাস আগে আমরা রপ্তানির অর্ডার নিয়েছিলাম। ওই সময়ে প্রতি কেজি সুতার দাম ছিল ২ দশমিক ৭ থেকে ৩ ডলার। বর্তমানে ওই সুতার দাম ৪ ডলারের উপরে।
এতে পণ্যের খরচ অনেক বেশি বেড়েছে। কিন্তু বিদেশি ক্রেতারা দাম বাড়াচ্ছে না। ফলে তাদের অর্ডারকৃত পণ্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, নতুন কোনো অর্ডারও নেওয়া যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, এ অবস্থায় আমাদের কিছু করারও নেই। কারণ আন্তর্জাতিক বাজার আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। তার মতে, এই বাজার চীনসহ কয়েকটি দেশের মাফিয়াদের দখলে। তারা কারসাজি করে এভাবে দাম বাড়াচ্ছে।
শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল স্টিলের বাজারও ব্যাপক ঊর্ধ্বমুখী। এখানে চীনা ব্যবসায়ীদের হাত রয়েছে বলে অনেকের অভিযোগ। করোনার সময় চীনের নির্মাণ খাত কিছুটা শ্লথ হলে স্টিলের দাম পড়তে থাকে। কিন্তু বসন্তকালীন ছুটি শেষে চীনা কারখানাগুলো পূর্ণমাত্রায় উৎপাদনে গেছে। এতে দেশটির স্টিলের পণ্য ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় চাহিদাও বাড়তে থাকে। চীনা ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যে প্রচুর স্টিল মজুত করেছেন। এছাড়া চীনা সরকার ১২তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।
এটি বাস্তবায়নে ব্যাপক নির্মাণকাজ চালু রাখতে হবে। এ ধারণা সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা স্টিলের মজুত গড়েছেন। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে স্টিলের দাম বেড়েছে। আলোচ্য সময়ে লোহার দামও ব্যাপক বেড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, লোহার দাম আরও বাড়বে। বর্তমানে প্রতি টন লোহা বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ ডলার। এটি আরও বেড়ে ২০০ ডলারে উন্নীত হতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দামও বেড়েছে। করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে তেলের দাম পড়তির দিকে থাকলেও এখন বাড়তি দামে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে ব্যবসায়ীদের। যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) তথ্যমতে, চলতি বছরের শুরুতে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানির দাম ছিল ৬২ ডলার। গত জানুয়ারিতে এটি ছিল ৫৪ ডলার।
তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক করোনার শুরুতে তেলের উৎপাদন কমিয়ে দেয়। তখন অবশ্য চাহিদাও কম ছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববাজারে চাহিদাও বেড়েছে। এতে প্রায় প্রতিদিনই এই কাঁচামালের দাম বাড়ছে। এদিকে গত কয়েক মাসে বিশ্ববাজারে সংবাদপত্র শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল নিউজপ্রিন্টের দামও বেড়ে গেছে। গত তিন মাসে এ পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার ২০ শতাংশ