খবর৭১ঃ
প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আসছে। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পাঠ্যবই এবং শিক্ষার্থী মূল্যায়ন ব্যবস্থাও পাল্টে যাবে। দশম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা আলাদা বই পাবে।
শুধু দশম শ্রেণির পড়া বইয়ের উপরেই হবে এসএসসি পরীক্ষা। এইচএসসি পরীক্ষা হবে দুবার। প্রথমে একাদশ শ্রেণিতে পড়া বিষয়গুলোর ওপরে বছর শেষে পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। এর নম্বর নিজ নিজ শিক্ষা বোর্ড সংরক্ষণ করবে। পরে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়া বিষয়ের ওপর আবার পরীক্ষা দেবে শিক্ষার্থীরা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ফল যোগ করে এইচএসসির ফল ঘোষণা করা হবে।
তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা নেই। চতুর্থ থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত ৭০ শতাংশ নম্বর থাকবে ধারাবাহিক মূল্যায়নে। এছাড়া অষ্টম-নবমে ৬০, দশমে ৫০ শতাংশ এবং এইচএসসিতে ৩০ শতাংশ নম্বর ধারাবাহিক মূল্যায়নের আওতায় আসবে। ২০১২ সালের পর ফের শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার আসছে। এর আগে ১৯৯৫ সালেও এ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয়।
প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমের আলোকে এখন সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাক্রম তৈরি হচ্ছে। আগামী বছর শুধু চারটি শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দেয়া হবে। শ্রেণি চারটি হচ্ছে, প্রথম ও দ্বিতীয় এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম।
এসব শ্রেণির শিক্ষাক্রম লেখার কাজ ১৫ এপ্রিলের মধ্যে শেষ হবে। এরপরে পাঠ্যবই লেখা শুরু হবে। ২০২৪ সালের মধ্যে দশম শ্রেণি এবং ২০২৬ সালের মধ্যে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রমে বই প্রবর্তন শেষ হবে। এর আগে ২০২৩ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন পাঠ্যবই যাবে। আগামী বছর থেকে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দুই বছর মেয়াদি হবে।
চলতি বছর দেশের বিভিন্ন স্কুলে এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চলছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হলে সাপ্তাহিক ছুটি দু’দিন করে দেয়া হবে। বর্তমানে শিক্ষাক্রমে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার বিষয়ে কিছু বলা নেই। সরকারের নির্বাহী আদেশে পরীক্ষা দুটি হচ্ছে। প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমেও এ বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই বলে জানা গেছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, বর্তমানে ২০১২ সালে প্রবর্তিত শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া চলছে। বিশ্বব্যাপী ৫ বছর পরপর শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়ে থাকে। যুগের চাহিদা ও বাস্তবতা বিবেচনায় এটা স্বাভাবিক কার্যক্রমেরই অংশ। সেই হিসাবে আরও আগে এ পরিমার্জন আসা প্রয়োজন ছিল।
বর্তমানে নবম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ভাগ হয়ে যায়। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী, দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীই একই পাঠ্যবই পড়বে। এমনকি এ দুই শ্রেণিতে তারা প্রাক-বৃত্তিমূলক শিক্ষা নেবে।
এর অংশ হিসাবে অন্তত একটি ট্রেড নিতে হবে সবাইকে। এর পাঠের ওপর তারা নেবে হাতে-কলমে শিক্ষা। বিভাগভিত্তিক ভাগ হয়ে যাবে উচ্চ মাধ্যমিকে। তবে ওই স্তরে সব শিক্ষার্থীকে অন্তত তিনটি অভিন্ন বিষয় পড়তে হবে।
আর বিভাগভিত্তিক অন্তত তিনটি বিষয় থাকবে। প্রতিটি বিষয়ে তিনটি করে পত্র থাকবে। মূলত বর্তমানে নবম-দশম শ্রেণিতে বিভাগভিত্তিক শিক্ষায় বিভিন্ন বিষয়ে যে জ্ঞান পেত, একটি পত্র বাড়িয়ে সেটির প্রয়োজনীয় জ্ঞান দেয়া হবে, যাতে উচ্চশিক্ষায় বিশেষায়িত লেখাপড়ায় সংকট তৈরি না হয়।
উল্লিখিত পরিকল্পনা অনুযায়ী, নতুন শিক্ষাক্রমে বা পাঠ্যপুস্তকের আলোকে এসএসসি প্রথম পরীক্ষা হবে ২০২৫ সালে। আর প্রথম পর্বের এইচএসসি (একাদশ শ্রেণিতে) হবে ২০২৬ এবং দ্বিতীয় পর্বের এইচএসসি ২০২৭ সালে।
নবম শ্রেণিতে আলাদা পাঠ্যবই দেয়া হবে। সেটা ওই শ্রেণিতেই পড়া শেষ করবে। আর দশম শ্রেণিতে আলাদা বই দেয়া হবে। শুধু দশম শ্রেণিতে দেয়া বইয়ের ওপর হবে এসএসসি পরীক্ষা। বর্তমানে নবম-দশম শ্রেণিতে অভিন্ন বই দেয়া হয়। ২ বছরের পাঠের ওপর এসএসসি পরীক্ষা হয়।
এনসিটিবি সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ভিশন ২০৪১ বা দেশকে উন্নত জাতিতে পরিণত করার রূপকল্প, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার, জাতীয় শিক্ষানীতি এবং জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বিবেচনায় নিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম করা হচ্ছে। প্রথমে এর রূপ রেখা তৈরি করা হয়। সেটি অনুমোদনের পর এখন শিক্ষাক্রম লেখার কাজ চলছে।
এখন সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখা হবে। তবে আগামী বছর চারটি শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ্যবই যাবে। সেগুলোর শিক্ষাক্রম তৈরির কাজ ১৫ এপ্রিলের মধ্যে শেষ হবে।
যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম : বর্তমানে যে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই আছে তা দুই রকম। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত যোগ্যতাভিত্তিক। অর্থাৎ, পঞ্চম শ্রেণি পাশ করলে একজন শিক্ষার্থী কতটি যোগ্যতা অর্জন করবে তা নির্দিষ্ট আছে। আর মাধ্যমিকের শিক্ষাক্রম উদ্দেশ্যভিত্তিক। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে পাঠ দেয়া হয়। এরপর তা শিখছে কিনা তা পরীক্ষা নিয়ে যাচাই করা হয়।
কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা অর্জনের দিকে জোর দেয়া হয়েছে। এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, সাধারণত তাত্ত্বিকভাবে বা বই থেকে মানুষ কোনো বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে। এটা যখন হাতে-কলমে শিখবে তখন সেটা থেকে দক্ষতা অর্জন হবে। আর এই দক্ষতা প্রয়োগ করতে পারলে যোগ্যতা অর্জন হয়।
দশম শ্রেণি পাশ করার পর কোনো শিক্ষার্থী যদি আর পড়তে না চায় তাহলে সে যেন দক্ষতা-যোগ্যতার দিয়ে কর্মজীবনে যেতে পারে সেই লক্ষ্য এবারের শিক্ষাক্রমের। এজন্যই পাঠদানে এবার কমিউনিটির অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি থাকছে প্রাক-বৃত্তিমূলক শিক্ষা। এই বিষয়ের জন্য তিনটি ট্রেড থাকবে।
এগুলো হচ্ছে, সার্ভিস (সেবা খাত), ইন্ডাস্ট্রিয়াল (শিল্প) এবং অ্যাগ্রো (কৃষি) কেন্দ্রিক। এর মধ্যে যে কোনো দুটি ট্রেড প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকবে। সাধারণত যে এলাকায় যেটির আধিক্য বা চাহিদা সেখানে সেই ট্রেড দেয়া হবে। এরমধ্যে যে কোনো একটি নেবে শিক্ষার্থীরা। দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রত্যেক শিক্ষার্থীই এ প্রাক-বৃত্তিমূলক শিক্ষা নেবে।
দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই : ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে ১০টি অভিন্ন বই পড়তে হবে। এগুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ধর্মশিক্ষা, ভালো থাকা, শিল্প ও সংস্কৃতি এবং জীবন ও জীবিকা। শেষেরটিই প্রাক-বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিষয়। বর্তমানে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০ থেকে ১৩টি বিষয় পড়তে হয়।
প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য আলাদা বই থাকবে না। শিক্ষকেরা শেখাবেন। তাদের শেখার বিষয় শিক্ষক গাইডে উল্লেখ থাকবে। প্রাথমিকের জন্য নয় ধরনের বিষয় আছে। এগুলোর মধ্যে আছে- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ধর্মশিক্ষা, ভালো থাকা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। তবে সব বিষয়ে পাঠ্যবই থাকবে না। যেসব বই দেয়া হবে তার বাইরের বিষয়ে শিক্ষক গাইডে দেয়া নির্দেশনা থাকবে। শিক্ষকরা তা পড়িয়ে নেবেন।
মূল্যায়ন পদ্ধতি : পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে মূল্যায়নেও আসছে পরিবর্তন। পরীক্ষা নির্ভরতার পরিবর্তে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ধারাবাহিক মূল্যায়নে। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্তই থাকবে এটা। পরিকল্পনা হচ্ছে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক তাদের ধারাবাহিকভাবে মূল্যায়ন করবেন।
এর ভিত্তিতে পরের শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা হবে। চতুর্থ থেকে সপ্তম শ্রেণিতে ধারাবাহিক মূল্যায়ন থাকবে ৭০ শতাংশ। বাকি ৩০ শতাংশ নম্বরের পরীক্ষা থাকবে। অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে ৬০ শতাংশ থাকবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন, যা শিক্ষক করবেন শ্রেণিকক্ষে। বাকি ৪০ শতাংশ থাকবে আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা। নবম ও দশম শ্রেণিতে ৫০ শতাংশ থাকবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন। বাকি ৫০ শতাংশ পরীক্ষা। এছাড়া একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ধারাবাহিক মূল্যায়ন থাকবে ৩০ শতাংশ। বাকি ৭০ শতাংশ থাকবে আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা।
উল্লিখিত পরিকল্পনার অংশ হিসাবে এসএসসিতে ৫টি বিষয়ে পরীক্ষা হবে। এগুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান। বাকি পাঁচটি বিষয়ের মূল্যায়ন হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
উচ্চমাধ্যমিকে ৬টি বিষয়ে ১২টি পত্র থাকবে। এর মধ্যে একাদশ শ্রেণিতে সবাইকে তিনটি বিষয় পড়তে হবে। এগুলো হচ্ছে- বাংলা, ইংরেজি এবং ‘কমন’ একটি বিষয়। সেটি কী হবে তা অবশ্য এখনও নির্ধারিত হয়নি। তবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ওপর হতে পারে বলে জানা গেছে। এছাড়া বিভাগভিত্তিক তিনটি করে বিষয় থাকবে। প্রতিটি বিষয়ে পত্র থাকবে তিনটি।
এ ছয়টি বিষয়ের মধ্যে সাধারণ তিন এবং বিভাগ ভিত্তিক তিনটি থেকে প্রতিটির প্রথমপত্রসহ মোট ছয়টির ওপর একাদশ শ্রেণিতে পরীক্ষা হবে। আর দ্বাদশ শ্রেণিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের তিনটি বিষয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পত্রের মোট ছয়টি পত্রের পাবলিক পরীক্ষা হবে।
ধারাবাহিক মূল্যায়ন : এতে থাকছে- অ্যাসাইনমেন্ট ও বাড়ির কাজ, শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন, বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমে যুক্ত করা, আচরণ পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতাকেন্দ্রিক শিক্ষা (এক্সপেরিমেন্টাল লার্নিং) ইত্যাদি।
নতুন শিক্ষাক্রমের নির্দেশনা অনুযায়ী, উল্লিখিত চার শ্রেণির শিক্ষার্থীরা আগামী বছর থেকে সপ্তাহে ২ দিন ছুটি পাবে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত অবশিষ্ট ৬টি ক্লাসে নতুন শিক্ষাক্রমের বই গেলে তারাও সপ্তাহে ২ দিন ছুটি ভোগ করবে। সেই পর্যন্ত (২০২৪ সাল) তাদেরকে সপ্তাহে ৬ দিনই ক্লাসে যেতে হবে।
রঙিন বই : প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের যে চার শ্রেণির শিক্ষার্থীরা আগামী বছর নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ্যবই পাচ্ছে সেগুলো চার রঙে ছাপিয়ে দেয়া হবে। এগুলোর মধ্যে প্রথম দুই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বর্তমানে চার রঙে ছাপানো বই পাচ্ছে। এখন ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির সব বইও চার রঙে ছাপিয়ে দেয়া হবে।