খবর৭১ঃ
বিদেশে পলাতক পিকে হালদারের (প্রশান্ত কুমার হালদার) অন্তত ২৬০০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ ও ক্রোক করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আর্থিক খাতের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং দেশের বাইরে পাচারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। জব্দ করা সম্পদের মধ্যে তার ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবের ১৫৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা এবং তার সহযোগীদের হিসাবে স্থানান্তর করা ১১০০ কোটি টাকা রয়েছে।
এছাড়া প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা সমমূল্যের জমি, হোটেল ও ফ্ল্যাট ক্রোক করা হয়। দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের আবেদনের ভিত্তিতে সম্প্রতি এই নগদ অর্থ ও সম্পদের ওপর এই ক্রোকাদেশ দেন আদালত। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এদিকে পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে উল্লিখিত অভিযোগে ১০টি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে দুদক।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার গুলশান আনোয়ার প্রধান যুগান্তরকে বলেন, পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রায় চূড়ান্ত। তাদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা করার সুপারিশ কমিশনে দাখিল করা হবে।
দুদকের অনুসন্ধান ও গ্রেফতার করা কয়েকজনের জবানবন্দি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পিকে হালদার রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি থাকা অবস্থায় তার আত্মীয়স্বজনকে আরও বেশ কয়েকটি লিজিং কোম্পানির ইনডিপেনডেন্ট পরিচালক বানান।
তার একক কর্তৃত্বে অদৃশ্য শক্তির মাধ্যমে পিপলস লিজিংসহ বেশ কয়েকটি লিজিং কোম্পানির টাকা বিভিন্ন কৌশলে বের করে আত্মসাৎ করেন। পিপলস লিজিংয়ে আমানতকারীদের ৩০০০ কোটি টাকা বিভিন্ন কৌশলে আত্মসাৎ করে ওই কোম্পানিকে পথে বসিয়েছেন।
এমনকি তিনি এসব কোম্পানির স্থাবর সম্পদ বিক্রি করে দেন। আমানতকারীদের শেয়ার পোর্টফোলিও থেকে শেয়ার বিক্রি করে সমুদয় টাকা আত্মসাৎ করেন। এর মধ্যে বেশির ভাগ অর্থ তিনি দেশের বাইরে পাচার করেন।
আদালত সূত্রে জানা যায়, পিকে হালদারের সহযোগী রাশেদুল হক স্বীকার করেছেন, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক ও রেজা গ্রুপের চেয়ারম্যান শহীদ রেজা মূলত ছিলেন পিকে হালদারের প্রধান সহযোগী। পিকে হালদারের নির্র্দেশে তার বিভিন্ন কাগুজে প্রতিষ্ঠানে ২০০ কোটি ঋণ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া সিমটেকের মালিক সিদ্দিকুর রহমান, ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এমডি ইরফান উদ্দিন আহমেদ, পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী, পিকের সহযোগী রাজীম সোম, কাজী মোমরেজ মাহমুদ, স্বপন কুমার বিশ্বাস, অভিজিত, অমিতাভ অধিকারী, শঙ্খ ব্যাপারী, সুস্মিতা সাহা, গোপাল চন্দ্র গাঙ্গুলী, অতশী মৃধা, অমল চন্দ্র দাস, রতন কুমার বিশ্বাসকে দিয়ে জালিয়াতির কাজটি করেন। পিকে হালদার মূলত এদের এনআইডি কার্ড দিয়ে ভুয়া কোম্পানি বানিয়ে তা দিয়ে শত শত কোটি টাকা লিজিং থেকে লুট করেন।
দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, পিকে হালদার কৌশলে তার সহযোগীদের ব্যাংকে ১১০০ কোটি টাকা স্থানান্তর করেন। ওই টাকা জব্দ করে দুদক।
এর মধ্যে তার সহযোগী নওশেরুল ইসলাম ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণ দেখিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, এফএএস লিজিং ও পিপলস লিজিং থেকে ২০১৫-২০১৯ সালে তার একাধিক হিসাবে জমা করেন ৩৫২ কোটি টাকা। এই টাকা থেকে তিনি উত্তোলন করেন ২৪৩ কোটি ২ লাখ টাকা।
ওই হিসাব থেকে দুদক জব্দ করেছে ৯৫ কোটি টাকা। তার সহযোগী মমতাজ বেগম ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণ দেখিয়ে কয়েক বছরে তার একাধিক হিসাবে জমা করেন ৪ কোটি টাকা। উত্তোলন করেন ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ হিসাব থেকে দুদক জব্দ করেছে ২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
বাসুদেব ব্যানার্জি ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণ দেখিয়ে তার একাধিক হিসাবে জমা করেন ৭৬৪ কোটি টাকা। উত্তোলন করেন ৪৬২ কোটি টাকা। তার হিসাবে থাকা ৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা জব্দ করেছে দুদক।
পাপিয়া ব্যানার্জি কয়েক বছরে ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণ দেখিয়ে তার একাধিক হিসাবে জমা করেন ৫ কোটি ৩৫ কোটি টাকা। উত্তোলন করেন ৩৪ কোটি টাকা। এ হিসাব থেকে দুদক জব্দ করেছে ৬১ লাখ টাকা।
এদিকে পিকে হালদারের রূপগঞ্জে ৫৭ একর জমি, ঢাকার ফার্মগেটের আইবিএ হোস্টেলের পাশে ৬৬ কাঠা জমি, কক্সবাজারে রেডিসন হোটেল, উত্তরায় ১০ তলা বাড়ি, ধানমন্ডি ২নং রোডে একটি ফ্ল্যাটসহ প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা সমমূল্যের সম্পদ ক্রোক করেছে দুদক।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, পিকে হালদারের বন্ধু মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক একেএম শহীদ রেজা পাঁচটি প্রতিষ্ঠান থেকে ১০৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন।
অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের ৭টি ঋণ হিসাব থেকে ৩৩টি চেকের মাধ্যমে ওয়ান ব্যাংকের স্টেশন রোড শাখার গ্রাহক ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইরফান আহমেদ খান জেকে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে পরিচালিত একটি হিসাব থেকে ৭৪ কোটি টাকা সরিয়ে নিয়ে আত্মসাৎ করা হয়।
এ টাকাও জব্দের আওতায় আনা হয়েছে। পিকে হালদারের ব্যক্তিগত হিসাবের ১৫৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমা ও সমপরিমাণ উত্তোলন করা হয়, যা একজন ব্যাংকারের স্বাভাবিক লেনদেন। এ টাকাও জব্দ করা হয়েছে।
জানা যায়, আনান কেমিক্যালের এমডি অমিতাভ অধিকারী হলেও এর সুবিধাভোগী ছিলেন পিকে হালদার। ব্যবসা সম্প্রসারণের নামে তিনি ৭০ কোটি ৮২ লাখ টাকা ঋণ নেন। কিন্তু একটি টাকাও ব্যবসার কাজে ব্যবহার না করে সব টাকাই বিভিন্ন জনের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেন।
অমিতাভ অধিকারী হলেন পিকে হালদারের খালাতো ভাই। উজ্জ্বল কুমার নন্দী হলেন পিকে হালদারের পুরোনো অফিসের সহকর্মী।
অপরদিকে উজ্জ্বল কুমার নন্দী পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান এবং অমিতাভ অধিকারী পিপলস লিজিংয়ে পরিচালক হিসাবে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। বেনামি প্রতিষ্ঠান দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে টাকা বের করে সেই টাকা দিয়ে পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান ও পরিচালক হন তারা। পরবর্তী সময়ে একই কায়দায় পিপলস লিজিং থেকে টাকা বের করে প্রতিষ্ঠানটিকে পথে বসিয়েছেন।
হাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের পরিচালক স্বপন কুমার মিস্ত্রি, ব্যবস্থাপনা পরিচালক অমিতাভ অধিকারী ও সুস্মিতা সাহা হলেও প্রতিষ্ঠানটি নিয়ন্ত্রণ করতেন পিকে হালদার। ব্যবসা সম্প্রসারণের নামে ৬০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয় ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে।
ঋণের অর্থ লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের ধানমন্ডি শাখায় হাল ইন্টারন্যাশনালের নামে পরিচালিত ০২১৩৩০০১৪৬২নং হিসাবে সর্বমোট ৬২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়।
পরে ওই হিসাব থেকে পিকে হালদারের নিজ নামে পরিচালিত হিসাবসহ ‘আমরা হোল্ডিং লিমিটেড, মুন এন্টারপ্রাইজ, ওরিয়াল লিমিটেড, সন্দীপ করপোরেশন, ফ্যাশন পালস লিমিটেড ও মেলোডি হোমসের হিসাবে অর্থ সরিয়ে নেওয়া হয়।