খবর ৭১: যাত্রীদের প্রাইভেটকারে তুলেই প্রথমে তাদের হাত-পা বেঁধে ফেলা হতো। এর পর মুখ মুড়িয়ে দেওয়া হতো স্কচটেপ দিয়ে। তার পর পরানো হতো মাস্ক। আর চোখে পরিয়ে দেওয়া হতো চশমা, যেটি ভেতরের দিকটা কালো স্কচটেপে মোড়ানো থাকত। তেমনি একটি চশমার গ্লাসে সাঁটানো কালো স্কচটেপের সূত্র ধরেই সন্ধান মিলল মহাসড়কে অপহরণ ও হত্যাকারী চক্রের সদস্যদের।
সাভারে সাবেক সেনাসদস্য ফজলুল হক হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে সংঘবদ্ধ এমন একটি দুর্ধষ খুনিচক্রের সন্ধান পেয়েছে ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল। তাদের কাছ থেকে জব্দ করেছে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি প্রাইভেটকার।
দীর্ঘদিন ধরে গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলার সড়ক-মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ স্টপেজ থেকে যাত্রী নেওয়ার নাম করে তাদের সর্বস্ব ছিনতাই এবং মুক্তিপণ না পেয়ে হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ চালিয়ে আসছিল চক্রটি।
ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক নাজমুল হাসান জানান, চালক ছাড়াও অপরাধী দলের অন্যরা যাত্রীবেশে থাকতেন প্রাইভেটকারে। তারা যাত্রীদের টার্গেট করে দীর্ঘদিন ধরে এমন অপকর্ম চালিয়ে আসছেন বলে আমাদের কাছে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছেন। পরে তাদের নাম-ঠিকানা যাচাই করে দেখা যায় তারা বিভিন্ন থানার একই ধরনের অপরাধের পলাতক আসামি। সর্বশেষ খবর হচ্ছে, প্রত্যেকেই আদালতে তাদের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।
গ্রেপ্তাররা হলেন- পাবনার আমিনপুর থানার টাংবাড়ি গ্রামের সাত্তার শেখের ছেলে মাসুম শেখ, খুলনার সোনাডাঙা থানার রায়েরমহল গ্রামের মৃত শেখ কিসলু রহমানের ছেলে মোহাম্মদ জনি ও পাবনার সুজানগর থানার উদয়পুর মিয়াবাড়ি গ্রামের মৃত আশু মিয়ার ছেলে আবদুর রব মিয়া।
পরিদর্শক নাজমুল হাসান জানান, গত ২৪ জানুয়ারি সাভারের বিরুলিয়া কমলাপুর এলাকায় সড়কের পাশ থেকে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। মরদেহের পাশে পড়েছিল অর্থশূন্য মানিব্যাগ, একটি টিফিন ক্যারিয়ার, তার অনতিদূরে একটি মোবাইল ফোন আর একটি চশমা। চশমাটির গ্লাস ছিল কাল স্কচটেপে সাঁটানো। লাশ উদ্ধারের পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সাভার মডেল থানাপুলিশ, ঢাকা জেলা উত্তর ডিবি, পিবিআই ও র্যাব সদস্যরা।
প্রাথমিক তদন্তে অজ্ঞাত মরদেহটি ফজলুল হকের (৪৫) বলে শনাক্ত করা হয়। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়া ফজলুল হক মানিকগঞ্জের শিবালয় থানা কাতরাসীন শশীনারা গ্রামের বাসিন্দা। একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির নিরাপত্তা প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ঘটনার দিন গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের শিবালয় থেকে অফিসের উদ্দেশে বের হয়েই নিখোঁজ হন তিনি। লাশ শনাক্তের পর গত ২৫ জানুয়ারি নিহত ফজলুল হকের স্ত্রী রাবেয়া বেগম সাভার মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
পরিদর্শক নাজমুল হাসান বলেন, মানিব্যাগ থেকে টাকা খোয়া যাওয়ায় হত্যাকারী সম্পর্কে আমাদের সন্দেহ ছিল সড়কে ছিনতাকারীদের প্রতি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জব্দ আলামতে মধ্যে স্কচটেপে মোড়ানো একটি চশমা দেখেই আমাদের সন্দেহ প্রকট হয়। সেই সূত্র ধরে এ ধরনের অপরাধ করে এমন দুটি গ্রুপকে আমরা শনাক্ত করি। তবে সেখান থেকে কোনো ক্লু না পেয়ে আমরা মানিকগঞ্জ থেকে সাভারের বিরুলিয়া পর্যন্ত সড়কের পাশে থাকা ৩৫টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করি। সেখানেও কাক্সিক্ষত কিছু না পাওয়ায় আমরা শিবালয় থানায় দুটি সাধারণ ডায়েরির সন্ধান পাই। সেখানে দুজনের অভিযোগ ছিল, নির্দিষ্ট গন্তব্য যাওয়ার পথে অল্প ভাড়ায় প্রাইভেটকারে উঠে তারা পড়েন অপহরণকারীদের খপ্পরে। তাদের একজন বিকাশের মাধ্যমে অন্যজন ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বুথ থেকে নিজে টাকা তুলে প্রাণে রক্ষা পান। সেই বিকাশ নম্বর ধরে শুরু হয় নতুন তদন্ত। বেরিয়ে আসে ক্লু।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা জানান, গত ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মানিকগঞ্জের উথুলি বাসস্ট্যান্ড থেকে মতিঝিল পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে ফজলুলকে প্রাইভোটকারে উঠানো হয়। পরে তার কাছে থাকা মোবাইল ও টাকা ছিনিয়ে নিতে চাইলে তিনি বাধা দেন। এ সময় তার হাত-পা বেঁধে কালো চশমা পরিয়ে দেয় গ্রেপ্তাররা। একপর্যায়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করলে গলায় থাকা মাফলার দিয়ে প্যাঁচ দিয়ে দুজন দুই দিকে টেনে ধরলে ফজলুল মারা যান। পরে সাভারের কমলাপুর এলাকায় মরদেহ ফেলে মিরপুরের দিকে চলে যায় তারা।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন সরদার জানান, সম্পূর্ণ একটি ক্লুলেস হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করেছে পুলিশে গোয়েন্দা শাখা। এমন চক্র বিভিন্ন সড়কে সক্রিয়। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনা অব্যাহত থাকবে।