‘সুদিন’ হারিয়েছে বাগেরহাটের সিনেমা হল

0
362

স্টাফ রিপোটার, বাগেরহাট
ছিল জৌলুস, দর্শকদের আনাগোনায় সারাদিন থাকত সরগরম। বাগেরহাটের মানুষের আবেগের সঙ্গে মিশে ছিল ‘লাইট হল’ নামটি। ব্রিটিশ শাসনামলের একেবারে শেষদিকে ১৯৩৯ সালে শহরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কাজী সায়েম উদ্দিন বিদেশ থেকে মালামাল আনিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এ সিনেমা হল। সেখানে চলত বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার ছবি। ৮২ বছর বয়সে লাইট হল হারিয়েছে তার জৌলুস। যৌবনের তীব্র উচ্ছ্বাস হারিয়ে লাইট হাউস এখন স্বজনহারা বৃদ্ধের মতো নিঃসঙ্গ। এখন আর লাইট হলের পর্দার আবেগে ভাসেন না দর্শকরা। তাই ক্লান্ত বড় পর্দা নিচ্ছে বিশ্রাম, সঙ্গে অন্যান্য যন্ত্রপাতিও।
তবে শহরের রেড রোড এলাকার হলটি এখনও সবাই একনামে চেনেন। প্রায় শতাব্দী প্রাচীন এই প্রেক্ষাগৃহটির প্রতিষ্ঠালগ্নে বাগেরহাট ছিল রাজশাহী বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসনের বিভাগীয় কমিশনার বাগেরহাটে গিয়ে এই বিনোদন কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। তখন থেকে শুধু বাগেরহাটই নয়, আশেপাশের কয়েকটি জেলার লাখো মানুষের বিনোদনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে লাইট হল। হলে ছবি চালানো থেকে শুরু করে সার্বিক বিষয়গুলোর দেখাশোনা করতেন একজন ম্যানেজার। তখনকার দিনে সিনেমা হলের ম্যানেজারের এলাকায় ছিল আলাদা দাপট। সবাই এক নামেই চিনত তাকে। লাইট হলের তেমনই একজন সুপরিচিত ম্যানেজার ছিলেন অধীর কুমার সাহা।

বাগেরহাটের ঐতিহ্যবাহী প্রেক্ষাগৃহটির সুপরিচিত এই ম্যানেজার থাকতেন শহরের সাহাপাড়া এলাকায়। জীবনের একটা দীর্ঘ সময় এই দায়িত্ব পালন করেছেন অধীর। স্বাধীনতার পরেও অনেক বছর এ পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তবে প্রায় এক যুগ আগে পরিবার-পরিজন নিয়ে চলে যান ভারতে। পরে এ পদে বসেন হৃষীকেশ দাস। ২০০৯ সাল পর্যন্ত লাইট হলের ম্যানেজার ছিলেন তিনি। এখনও তিনি ‘ম্যানেজার’-ই আছেন। তবে লাইট হলের নয়, কাজী সায়েম উদ্দিনের উত্তরসূরি কাজী মনছুর টিপুর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখভালের দায়িত্ব হৃষীকেশের কাঁধে। অব্যাহত লোকসান ও ভালো সিনেমার অভাবে দর্শকদের হল বিমুখীতার কারণে ২০০৯ সালের মে মাসে একপ্রকার বাধ্য হয়েই বন্ধ করা হয় প্রেক্ষাগৃহটি। তবে ভবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে বসানো হয়েছে অনেকগুলো সিসিটিভি ক্যামেরা।

আর হলের দোতলায় পড়ে আছে ব্রিটিশ আমলের মেশিন ও অন্যান্য সরঞ্জাম। নিচতলায় জোয়ারের পানির প্রবেশ ঠেকাতে বালু ফেলে উঁচু করা হয়েছে। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে নিচতলায় দর্শকদের বসার চিহ্নটুকুও। উপরতলায় নারী দর্শনার্থীদের বসার আসনগুলো এখনও দেখা যায়। তবে জীর্ণ ভবনের ছাদের পাটাতন আর দরজা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম।

এই হলটির সঙ্গে বংশ পরম্পরায় জড়িয়ে ছিল ১১টি পরিবার। তাদের অনেকেই এখন বেঁচে নেই। যারা আছেন তারা বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন। মাঝে মধ্যে পুরনো স্মৃতি মনে পড়লে হলের কাছে এসে ঘুরে দেখে যান।

লাইট হলের সর্বশেষ ম্যানেজার হৃষীকেশ দাস বলেন, এক সময় বাংলা ছবি দেখতে মানুষের উপচে পড়া ভিড় ছিল। ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার ছবিও খুব ব্যবসা সফল ছিল। ভারতীয় বাংলা ছবির পাশাপাশি দেশে তৈরি ভালো ছবিরও কদর ছিল। স্বাধীনতার পরেও বেশ কয়েক বছর ভালো ছবি নির্মিত হয়েছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্রে অশ্লীলতার ছাপ বাড়তে থাকে। পাশাপাশি ভারতীয় বাংলা ছবি সিনেমা হলে চালানোর নিষেধাজ্ঞায় ভাটা পড়তে থাকে দর্শকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ হল বিমুখ হয়ে পড়ে। ফলে অব্যাহত লোকসানের মুখে হতাশ হয়ে মালিক পক্ষ সিনেমা হল বন্ধ করতে বাধ্য হয়। এতে অসংখ্য মানুষ কাজ হারায়। তিনি আরও বলেন, ২০০৯ সালে লাইট হল সিনেমা বন্ধ হলে আমি ও আরও তিন-চার কর্মচারীকে তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়েছেন। বাকিরা দোকান ও ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা করে বেঁচে আছেন।

লাইট হল মালিকপক্ষের মতো সবার তো আর্থিক সঙ্গতি কিংবা ইচ্ছা নেই। সে কারণে বাগেরহাটের বেশ কয়েকটি বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমা হলের সাবেক কর্মীদের খবর রাখেন না কেউই। অনেকের তো কোনো খোঁজই নেই বহুদিন ধরে।

লাইট হলের বর্তমান কর্ণধার বাগেরহাটের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী কাজী মনছুর টিপু বলেন, ১৯৭৭ সালে আমার দাদা মারা যাওয়ার পর লাইট হলের হাল ধরি। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও ভালোবাসা থেকেই ২০০৯ সাল পর্যন্ত চালু রেখেছিলাম। কিন্তু নানা কারণে আমার মতো অনেকেই হল বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। এ শিল্পে জড়িত অনেক পরিবার চাকরি হারিয়েছে। লাইট হল সিনেমা হলের সঙ্গে জড়িত ম্যানেজার হৃষীকেশ দাস, স্টাফ মীর খোকন, মো. সোহেলকে আমার বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়েছি। এছাড়া সাবেক কর্মী আব্দুল জব্বার পৌরসভায় ও আব্দুল হামিদ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পিয়নের চাকরি করছে। সাবেক কর্মীদের মধ্যে চার জন মারাও গেছে। লাইট হলের ব্যান্ড বাদক অর্থাৎ প্রচার কাজে নিয়োজিত ছিলেন আব্দুল হামিদ। এখন তার বয়স ৮৩ বছর বছর।

লাইট হলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, দেশীয় ছবির পাশাপাশি এ প্রেক্ষাগৃহে ভারতীয় বাংলা, হিন্দি ছবি খুব চলতো। উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ছবি খুব দেখত মানুষ। তখন এত দর্শক হতো যে একবার বাগেরহাটে হেলিকপ্টার ভাড়া করে ‘শিল্পী’ ছবির পোস্টার সারা জেলায় বিলি করেছিলেন হলের মালিক কাজী সায়েম। মর্নিং শোতে ইংরেজি ছবি ছাড়াও বিকেল ৩টা, সন্ধ্যা ৬টা ও রাত ৯টার শো-তে দর্শকরা টাকা দিয়েও টিকিট পেতেন না অনেক সময়। অতিরিক্ত চাহিদার কারণে টিকিট বিক্রি হতো ব্ল্যাকে। সেদিন আর ফিরবে না। তবে এখনও ইচ্ছা হয় লাইট হলে গিয়ে ছবি দেখতে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here