খবর৭১ঃ জুলকারনাইন সায়ের খান ওরফে সামিউল আহমেদ খান ওরফে সামি। দেশে বর্তমানে আলোচিত এই নাম। কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক টেলিভিশন চ্যানেল আলজাজিরায় বাংলাদেশ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের পর আলোচনায় আসেন এই সামি। বাংলাদেশবিরোধী চক্রান্তের সঙ্গে সামির নাম অনেক দিন ধরেই আলোচিত হচ্ছে। অথচ এই সামিকেই কিনা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন রমনা থানার ওসি মনিরুল ইসলাম! থানাপুলিশ নাকি এই সামির ঠিকানা খুঁজে পায়নি।
অথচ অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার ছেলে সামির বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। এমনকি পুলিশের হাতে আগে তিনি গ্রেফতারও হয়েছেন। কাউকে না জানিয়ে ওসি কীভাবে এই মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট দিলেন, তা নিয়েই পুলিশে তোলপাড় চলছে।
কেন তাকে অব্যাহতি দেওয়া হলো—অনুসন্ধান করতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি ঐ মামলা অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে।
তবে রমনা থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, ‘তদন্তে তার প্রকৃত ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়নি, এ কারণে তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।’ এমন একজন আলোচিত ব্যক্তির ঠিকানা খোঁজার প্রকৃত চেষ্টা কি পুলিশের পক্ষ থেকে ছিল, নাকি অন্য কোনো বিষয় এর সঙ্গে জড়িত—জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, ‘বিষয়টি এখন পুলিশ সদর দপ্তরের উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। যদি এর মধ্যে অন্য কিছু ধরা পড়ে, তাহলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ এই সামি রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছেন।’
‘আই এম বাংলাদেশি’ নামে একটি পেজ থেকে ফেসবুকে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে গত বছরের মে মাসে সামিসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রমনা থানায় মামলা করেছিল র্যাব। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ঐ পেজের মূল ব্যক্তির সন্ধান না পাওয়ায় চার্জশিট থেকে সামিসহ আট জনকে বাদ দেওয়া হয়। গত ১১ জানুয়ারি তিন জনকে আসামি করে চার্জশিট দেয় পুলিশ। কিন্তু আলজাজিরা টেলিভিশনের খবরের ভিত্তিতে জানা যায়, ঐ পেজের মূল ব্যক্তি হলেন সামি। পরে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মামলাটির অধিকতর তদন্ত করতে গত ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আদালতের নির্দেশনা পাওয়ার পর আমরা মামলাটির তদন্ত শুরু করেছি। এখন বিষয়টি তদন্তাধীন।’
‘আই এম বাংলাদেশি’ নামে ঐ পেজের এডিটর হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে পরিচালনা করছেন কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, আশিক ইমরান, ফিলিপ শুমাখার, স্বপন ওয়াহিদ ও লেখক মুসতাক আহমেদ। তাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নেত্র নিউজের সাংবাদিক তাসনীম খলিল, সাহেদ আলম, ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীন, রাষ্ট্রচিন্তার কর্মী দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়া, মিনহাজ মান্নান ও আলোচিত সামি। রমনা থানায় র্যাব যে মামলাটি করেছিল, ঐ মামলায় ৬ নম্বর আসামি ছিলেন সামি। অথচ মামলার ১১ আসামির মধ্যে আট জনকেই চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, র্যাব কর্মকর্তা পরিচয়ে আর্থিক প্রতারণায় জড়িত থাকার ঘটনায় ২০০৬ সালে সামি গ্রেফতার হয়েছিলেন। তিনি এখন হাঙ্গেরিতে বসবাস করছেন। পাসপোর্ট তৈরিতে প্রতারণার মাধ্যমে নিজের এবং বাবার নামের অংশবিশেষ পরিবর্তন করেন। ১৯৮৪ সালে জন্মগ্রহণকারী সামি ১৭ বছর বয়সে এক সেনা কর্মকর্তার ট্র্যাকসুট চুরি করে ধরা পড়েছিলেন। ২০০০ সালে চোরাই হাতির দাঁত বিক্রি করতে গিয়েও ধরা পড়েন।
কিশোর বয়স থেকেই সেনানিবাসে নিষিদ্ধ ছিলেন সামি। গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই সামি কখনো তানভীর সাদাত, কখনো শায়ের জুলকারনাইন, কখনো বা জুলকারনাইন শায়ের খান সেজে প্রতারণাসহ অগণিত অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গ্রেফতারের পরও তিনি জামিনে ছাড়া পেয়ে দেশ ছাড়েন।
জানা গেছে, সামির প্রকৃত নাম সামিউল আহমেদ খান। তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল মো. আবদুল বাসেত খান। চার সন্তানের মধ্যে সামিউল আহমেদ খান সবার বড়। ১৪ বছর বয়সে সামি মাকে হারায়। এর দুই বছর পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সত্-মায়ের সংসার থেকেই অন্ধকার জগতে পা বাড়ান সামি। ক্যাডেট কলেজ থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর ভর্তি হন কুমিল্লার ইস্পাহানি স্কুলে।
১৫-১৬ বছর বয়স থেকে ড্রাগ নেওয়া, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাসহ নানা অপরাধে যুক্ত হন তিনি। নিজেকে সেনা কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে প্রথম স্ত্রীকে না জানিয়েই এক সেনা কর্মকর্তার মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন সামি। অ্যান্টেনা ভাঙা ভিএইচএফ (ওয়াকিটকি) নিয়ে মার্কিন দূতাবাসের নিরাপত্তা কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেওয়ার নামে কয়েকজনের কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও ছিল সামির বিরুদ্ধে। শ্বশুরের অর্থে হাঙ্গেরিতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করার পর বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন সামি।