খবর৭১ঃ
একুশে পদকপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন আর নেই। রবিবার বিকালে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।
রাবেয়া খাতুনের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘রাবেয়া খাতুনের মৃত্যু দেশের সাহিত্য অঙ্গনের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। বাংলা সাহিত্যের প্রসারে তার অবদান চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
রাষ্ট্রপতি মরহুমার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
রাবেয়া খাতুনকে কখও ও কোথায় দাফন করা হবে এখনো পরিবারের পক্ষ থেকে বিষয়টি জানানো হয়নি।
১৯৩৫ সালে ২৭ ডিসেম্বর ঢাকার বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন রাবেয়া খাতুন। তার পৈতৃক বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর গ্রামে। তার বাবা মৌলভী মোহাম্মদ মুল্লুক চাঁদ এবং মা হামিদা খাতুন।
তার স্বামী প্রয়াত এটিএম ফজলুল হক ছিলেন দেশের চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রথম পত্রিকা সিনেমার সম্পাদক ও চিত্রপরিচালক। বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘প্রেসিডেন্ট’এর পরিচালকও তিনি।
১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই বিয়ে হয় ফজলুল হক ও রাবেয়া খাতুনের। তাদের চার সন্তান ফরিদুর রেজা সাগর, কেকা ফেরদৌসী, ফরহাদুর রেজা প্রবাল ও ফারহানা কাকলী।
৮৬ বছরে মারা যাওয়া রাবেয়া খাতুন সাহিত্যের সকল শাখায় সফলভাবে বিচরণ করেছেন। দীর্ঘ জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যকে যেমন সমৃদ্ধ করেছেন তেমনি ভূষিত হয়েছেন অসংখ্য পুরস্কারেও।
একুশে পদক, বাংলা একাডেমিসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত রাবেয়া খাতুন লেখালেখি ছাড়া শিক্ষকতাও করেছেন। সাংবাদিকতার সঙ্গেও দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন তিনি। ইত্তেফাক, সিনেমা পত্রিকা ছাড়াও তাঁর নিজস্ব সম্পাদনায় পঞ্চাশ দশকে বের হতো ‘অঙ্গনা’ নামের একটি মহিলা মাসিক পত্রিকা। তাঁর প্রকাশিত পুস্তকের সংখ্যা একশ’রও বেশি। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস, গবেষণাধর্মী রচনা, ছোটগল্প, ধর্মীয় কাহিনী, ভ্রমণ কাহিনী, কিশোর উপন্যাস, স্মৃতিকথা ইত্যাদি।
রেডিও, টিভিতে প্রচারিত হয়েছে অসংখ্য নাটক, জীবন্তিকা ও সিরিজ নাটক। তাঁর গল্পে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে কয়েকটি। রাবেয়া খাতুন উপন্যাস লিখেছেন পঞ্চাশটিরও বেশি, এযাবৎ কাল পর্যন্ত চার খণ্ডে সংকলিত ছোটগল্প সংখ্যায় চারশোরও বেশি। ছোটদের জন্য লেখা গল্প-উপন্যাসও সংখ্যায় কম নয়।
রাবেয়া খাতুন বাংলাদেশের ভ্রমণসাহিত্যের প্রধানতম লেখক। ছোটগল্প দিয়ে শুরু হলেও লেখকপরিচয়ে প্রথমত তিনি ঔপন্যাসিক। প্রথম উপন্যাস মধুমতী (১৯৬৩) প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই শক্তিমান কথাসাহিত্যিক হিসাবে পরিচিতি পান। ক্ষয়িষ্ণু তাঁতি সম্প্রদায়ের জীবনসংকট ও নাগরিক উঠতি মধ্যবিত্ত জীবনের অস্তিত্ব জিজ্ঞাসার মধ্যে ব্যক্তিকে আবিষ্কার করেছিলেন রাবেয়া খাতুন এই উপন্যাসে। রাবেয়া খাতুন ভ্রমণসাহিত্য রচনাকে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম হিসাবে বিবেচনা করেছেন বলে তাঁর ভ্রমণসাহিত্যের বইও অনেকগুলো। বেশ কিছু আত্মজৈবনিক স্মৃতিমূলক রচনা লিখেছেন। একাত্তরের নয় মাস (১৯৯০) বইয়ে লিখেছেন একাত্তরের শ্বাসরূদ্ধকর দিনগুলোর কথা।
সাহিত্যর্চ্চার জন্য পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন একুশে পদক (১৯৯৩), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৩), নাসিরুদ্দিন স্বর্ণ পদক (১৯৯৫), হুমায়ূন স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৯), কমর মুশতারী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৯৪), শের-ই-বাংলা স্বর্ণ পদক (১৯৯৬), ঋষিজ সাহিত্য পদক (১৯৯৮), লায়লা সামাদ পুরস্কার (১৯৯৯) ও অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৯)।
ছোট গল্পের জন্য পেয়েছেন নাট্যসভা পুরস্কার (১৯৯৮)। সায়েন্স ফিকশন ও কিশোর উপন্যাসের জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন শাপলা দোয়েল পুরস্কার (১৯৯৬), অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার (১৯৯৮), ইউরো শিশু সাহিত্য পুরস্কার (২০০৩)। ছোটগল্প ও উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ হয়েছে প্রেসিডেন্ট (১৯৬৬), কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি (২০০৩), মেঘের পরে মেঘ (২০০৪), ধ্রুবতারা ও মধুমতি (২০১০)।
টিভি নাটকের জন্য পেয়েছেন টেনাশিনাস পুরস্কার (১৯৯৭), বাচসাস (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি) পুরস্কার, বাংলাদেশ কালচারাল রিপোর্টাস এসোসিয়েশন মিলেনিয়াম অ্যওয়ার্ড (২০০০), টেলিভিশন রিপোর্টাস অ্যাওয়ার্ড (২০০০)সহ তিনি এ যাবত অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। বর্তমানে তিনি লেখালেখির কাজে নিবেদিত।