শিক্ষায় অলস বছর হয়নি আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম

0
346
শিক্ষায় অলস বছর হয়নি আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম

খবর৭১ঃ বিদায়ী বছরে শিক্ষায় নানা কাজ হয়েছে। কিন্তু সবই আক্রমণের মুখে আত্মরক্ষার মতো। ৯ মাস ধরে বন্ধ আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে সাড়ে ৩ কোটি ছাত্রছাত্রী বঞ্চিত আনুষ্ঠানিক শ্রেণি কার্যক্রম থেকে।

ফলে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের শিখন ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ক্ষতিপূরণে তাদের আগের শ্রেণির পাঠ টেনে নিতে হচ্ছে পরের শ্রেণিতে। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা পড়ছে দীর্ঘ সেশনজটে।

পিছিয়ে গেছে বিভিন্ন পরীক্ষা। প্রশাসনিক কার্যক্রমেও তৈরি হয়েছে ধীরগতি। ইতোমধ্যে নতুন কারিকুলামের প্রবর্তনে একটি বছর পেছাতে হয়েছে। পাঠ্যবই মুদ্রণাদেশ দেয়া হয়েছে বিলম্বে।

দুইবছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক ও নিুমাধ্যমিকে বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালু করা সম্ভব হয়নি। বাতিল হয়েছে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ধারাবাহিক মূল্যায়নের পাইলটিং, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টের চূড়ান্ত পর্বের খেলা।

দেশের উপজেলা পর্যায়ে জাতীয়করণ করা স্কুল-কলেজের দাফতরিক কার্যক্রম ছিল গতিহীন। আর ধীরে আগাচ্ছে শিক্ষা আইন ও এমপিও নীতিমালা চূড়ান্তকরণসহ বিভিন্ন বিধিবিধান তৈরির কাজ। প্রথমবারের মতো সব ধরনের ভর্তি, বার্ষিক, পিইসি, জেএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছে। সব মিলে শিক্ষায় পার হচ্ছে একটি অলস বছর।

আলোচ্য বছরে শিক্ষা খাতে অন্যতম আকর্ষণ ছিল জাতির পিতাকে নিয়ে কোমলমতি প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিঠি। এটি জাতির পিতার জন্মদিন ১৭ মার্চে পৌনে ২ কোটি শিক্ষার্থীর পাঠ করার কথা ছিল। কিন্তু করোনায় স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ায় সেই কর্মসূচি স্থগিত করতে হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি আর এমপিওবিহীন শিক্ষকদের করোনাকালীন আর্থিক সহায়তার কাজটি করে প্রশংসা কুড়িয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এসএসসির ফল প্রকাশ, উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি, ভর্তির নীতিমালা তৈরিসহ কিছু কিছু রুটিন হয়েছে। চলছে নতুন কারিকুলাম তৈরির কাজ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গুচ্ছবদ্ধ ভর্তি পরীক্ষার আওতায়ও অনেকটাই আনা সম্ভব হয়েছে।

এছাড়া এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন অনুযায়ী অনলাইনে ক্লাস করার ডিভাইস বা মোবাইল ফোন প্রদান এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাশ্রয়ী দামে ডাটা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গ্রেড সমস্যার সমাধানসহ শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত কয়েকটি সমস্যা সমাধান করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ও প্রশংসা কুড়িয়েছে।

কিন্তু শিক্ষা খাতে দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেটের সদস্যদের বহাল তবিয়তে থাকার ঘটনায় অসন্তোষ আছে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে। এছাড়া শিক্ষাভবনকেন্দ্রিক বিভিন্ন সেবা কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা এবং ভোগান্তির ঘটনায় ক্ষুব্ধ সরকারি-বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা।

বিপরীত দিকে নীতিমালা তৈরির নামে ঝুলে আছে সাধারণ (শিক্ষক) কর্মকর্তাদের বদলি কার্যক্রম। পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপনে বই কেনা কার্যক্রমে উদ্ভূত বিতর্ক এবং প্রাথমিক শিক্ষকদের অবৈধ সনদের বৈধতা দেয়ার বিষয়টিও শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মুখে মুখে।

বিদায়ী বছরেও বিভিন্ন দাবিতে শিক্ষকরা রাজপথে ছিলেন। বিশেষ করে ইবতেদায়ি শিক্ষকরা জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন করেন। করোনার কারণে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে কেজি স্কুলগুলো বন্ধের পথে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ৯০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান আর খোলা সম্ভব না-ও হতে পারে।

শিক্ষা বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, করোনাকালে শিক্ষা খাতে যে সমস্যা ও সংকট তৈরি হয়েছে, তা কাটানো খুবই কঠিন হবে। এর প্রাথমিক প্রভাব পড়বে ঝরে পড়ার হারে। এটা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাবে। এর প্রভাব হিসেবে বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম ইত্যাদিও বাড়বে।

আর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হিসেবে শিক্ষার্থীদের শিখন-শিক্ষণে যে প্রভাব পড়েছে, সেটা কাটাতে সুষ্ঠু পরিকল্পনা দরকার। পাশাপাশি সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তদারকির পাশাপাশি শিক্ষকদের আন্তরিক সহায়তা প্রয়োজন। তবে করোনাকালে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ বিশেষ করে বছর শেষে অ্যাসাইনমেন্ট পদ্ধতি বেশ ইতিবাচক মনে হয়েছে।

তবে করোনাকালে শিক্ষার ক্ষয়ক্ষতি পোষাতে দুই মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ যথাযথ পদক্ষেপ প্রশংসা কুড়িয়েছে। ১৭ মার্চ থেকে ছুটি শুরু হয় শিক্ষাঙ্গনে। এর কিছুদিন পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় টেলিভিশনে পাঠদান কার্যক্রম চালু করে। এটি অনুসরণ করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

পরে উভয় মন্ত্রণালয় অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে, যা দেশের ইতিহাসে প্রথম। করোনার বিদায় হবে-এই আশায় অল্প অল্প করে ছুটি বাড়ানো হয়। পাশাপাশি বারবার শিক্ষা পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। কিন্তু হতাশা তৈরি করে করোনা মহামারী। সব প্যাকেজ বাতিল হয়ে যায়।

শেষ পর্যন্ত শিক্ষায় ৩০ দিনের কর্মসূচি নিয়ে ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিখন কার্যক্রম চালু রাখা হয়। আর প্রাথমিকে শিক্ষকরা স্থানীয়ভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কিংবা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আবার কোথাও অনলাইনে পাঠদান প্রক্রিয়া চালু রেখেছেন। যদিও উভয় স্তরে পরীক্ষা ছাড়া স্বয়ংক্রিয় পাস পেয়ে যাবে শিক্ষার্থীরা। আগের রোল নিয়ে উঠবে পরের শ্রেণিতে।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে মহাজোট। দায়িত্ব গ্রহণের কয়েকদিনের মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের সংকট মোকাবেলা করতে হয়। তখন এই বই বাজারে বিক্রি হতো। নতুন সরকার তখন পরের বছর থেকেই নবম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে বই বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়।

পরের জানুয়ারিতে শিক্ষার্থীদের হাতে ৩৫ কোটি বিনামূল্যের বই তুলে দিয়ে বাহবা কুড়ায় সরকার। সেই থেকে শিক্ষায় নতুন বছর শুরু হয় পাঠ্যপুস্তক উৎসব বা কোটি কোটি শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যের বই বিতরণের মাধ্যমে। ২০২০ সালটিও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মুখের প্রস্ফুটিত হাসিতে উদ্ভাসিত হয় প্রতিষ্ঠান।

তবে এক্ষেত্রে অভিভাবকদের অস্বস্তি ছিল, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারের বেঁধে দেয়া নীতিমালার অঙ্ক লঙ্ঘন করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করেছে অর্থ।

শিক্ষার বছরের শুরুতে আরেকটি সুখবর ছিল পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতাদের পক্ষ থেকে। এতদিন বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান যে যার মতো দর আরোপ করে বই বিক্রি করত। নতুন বছরে বিভিন্ন শ্রেণির অনুশীলনমূলক ও শিক্ষাসহায়ক গ্রন্থ পাঠের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে দর ও বইয়ের আকার নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ফলে এসব বইয়ের দাম ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছিল।

দেশের সাড়ে ৭ সহস্রাধিক মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ নিয়োগের কমিটিতে মহাপরিচালকের প্রতিনিধি মনোনয়নের ইস্যুতে কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগ (টিএমইডি) এবং মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের (ডিএমই) মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই তৈরি হয়েছিল ফেব্রুয়ারিতে।

বিভাগের নির্দেশে অধিদফতরের মহাপরিচালকের প্রতিনিধি হিসেবে জেলা প্রশাসক (ডিসি) বা তার মনোনীত ব্যক্তিকে মনোনয়নের সার্কুলার জারি করা হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে দুই সপ্তাহ না যেতেই সেই সার্কুলার প্রত্যাহার হয়েছে। এ নিয়ে জেলাপ্রশাসকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল।

বেশ কয়েকজন এ নিয়ে বিভাগে চিঠিও পাঠিয়েছিলেন। এছাড়া ওই অধিদফতরের কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতিতে জড়ানোর অভিযোগ আছে। শেষ পর্যন্ত তারা বহাল আছে জানা গেছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধের পাশাপাশি জবাবদিহিতা তৈরির লক্ষ্যে কার্যক্রম অটোমেশন করার উদ্যোগ নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ)। ১ মার্চ এই কার্যক্রম উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী।

জুন-জুলাইয়ে এসে হঠাৎ উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। প্রতিষ্ঠানগুলো টিউশন ফি আদায়ে অনেকটাই ছিল কঠিন। এছাড়া ভর্তি ফি আদায়েও মোটা অঙ্কের অর্থ আরোপ করা হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান শতভাগ পাওনা আদায় করে। অভিভাবকরা এই অর্থ বিভিন্ন হারে মওকুফ চেয়ে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন।

সরকার কারিগরি শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এই শিক্ষার উন্নয়নে নিয়েছে বিভিন্ন প্রকল্প। আলোচ্য বছরে ২১ হাজার কোটি টাকার বিশাল প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। অপরদিকে স্টেপ নামে একটি প্রকল্প শেষ হয়েছে। ওই প্রকল্পে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু কমিটির কাজ এখনও শেষ হয়নি। অভিযুক্তরা শাস্তির বদলে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন পেয়েছেন।

এ বছরে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তিতে বয়সের সীমা তুলে দিয়ে নতুন নীতিমালা করা হয়। তবে প্রত্যাশিত পর্যায়ে ভর্তির হার বাড়েনি। অপরদিকে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কার্যক্রমে গতিশীলতা ব্যাপক হারে কমেছে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ আর সেমিনারের সম্মানীর নামে লাখ লাখ টাকা ভাগবাটোয়ার অভিযোগ আছে।

ফল জালিয়াতির ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটিতে দোষীদের চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে বহাল আছে সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে বদলির আদেশ জারি হয়। তাকে রাখার ব্যাপারে বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেনদরবার করেন বলে জানা গেছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here