খবর৭১ঃ মধ্যে সমন্বয় না থাকায় অন্তহীন দুর্ভোগে নাকাল নগরবাসী। ঢাকার দুই নগরপিতা বিদ্যমান সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেও হিমশিম খাচ্ছেন। সেবা সংস্থাগুলোর কর্তৃত্ব একটি ছাতার নিচে না আসা পর্যন্ত বিদ্যমান সমস্যার সমাধান দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মোট সড়কের পরিমাণ প্রায় ৩৪০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় ১০২০ কিলোমিটার সড়ক ভাঙাচোরা। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা ওয়াসা, তিতাস গ্যাস, ডিপিডিসি, ডেসকো, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিআরটির উন্নয়ন কাজের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা মহানগরীর সড়ক খনন নীতিমালা ২০১৯ অনুযায়ী সব ধরনের উন্নয়ন কাজের খোঁড়াখুঁড়ি দিনের পরিবর্তে রাতে করা বাধ্যতামূলক হলেও বাস্তবে সেটা লংঘন হচ্ছে। এছাড়া উন্নয়ন কাজে জড়িত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ওপর দায়িত্ব বর্তায় ওই সড়কের সমস্যা লাঘবে ভূমিকা রাখা। এক্ষেত্রে সড়ক ভেঙে গেলে যথাসময়ে সংস্কার এবং অন্য কোনো সমস্যার সৃষ্টি হলে তা সমাধান করবে।
আর ধুলোবালি রোধে নিয়মিত পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করবে। বিধান অনুযায়ী, এটা বাধ্যতামূলক হলেও কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেসব মানছে না। দুই সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব কাজের ক্ষেত্রে এমন ব্যত্যয় হরহামেশা চোখে পড়ছে। সড়ক খনন নীতিমালায় ওয়ান স্টপ সমন্বয় সেল গঠনের সুপারিশ থাকলেও সেটা বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকার অন্যান্য সেবা সংস্থাগুলোকে সিটি কর্পোরেশনের নেতৃত্বে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে দুই মেয়র যেভাবে আহবান জানাচ্ছে, তাতে সাড়া দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘গত ৭ অক্টোবর ডিএসসিসি মেয়রের পক্ষ থেকে সেবা সংস্থাগুলোকে কর্মপরিকল্পনা দেয়ার আহবান জানানো হয়। ৩১ অক্টোবরের মধ্যে মাত্র ৪টি আবেদন জমা পড়েছে। এটা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়।’
এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয় গড়ে না ওঠায় নগরবাসী অন্তহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। এখান প্রতিকার নিশ্চিতকরণ, জনগণের টাকার অপচয় প্রতিরোধে মন্ত্রিপরিষদ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মেয়রদের নেতৃত্বে এ কাজ বাস্তবায়নে আরও প্রজ্ঞাপন জারি করে সহায়তা দিতে হবে।’
এ বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাছের খান যুগান্তরকে বলেন, ‘উন্নয়ন কাজ, সড়কে আবর্জনা ফেলা, প্লাস্টিক ও পলিথিন পোড়ানোর কারণে ধুলো দূষণের সৃষ্টি হচ্ছে। ধুলো নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার পাশাপাশি নগরবাসীর অসচেতনতাও দায়ী। আমরা ইউরোপ, আমেরিকার মতো শহর চাই, কিন্তু নিজেরা কোনো বিধিবিধান মানতে রাজি নই। এভাবে ধুলো দূষণমুক্ত বাসযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব শহর গড়ে তোলা কোনোভাবে সম্ভব নয়। এজন্য এখন সবাইকে এ বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে।’ এসব দূষণে মানুষ ঠাণ্ডা, কাশি, শ্বাসকষ্টসহ বহুবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর কাছে এসব বিষয় অজানা নয়। তারপরও তারা কর্তব্য পালনে চরম অবহেলার পরিচয় দিয়ে চলেছে।’
জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘সেবা সংস্থাগুলোর প্রকল্প অনুমোদন ও অর্থের সংস্থান ভিন্ন ভিন্ন সময়ে হওয়ায় যখন-তখন খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করা যাচ্ছে না। আমরা দুই মেয়র আলাপ-আলোচনা সাপেক্ষে বিদ্যমান সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন কাজের কারণে অনেক ধুলোবালু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। বিধি মোতাবেক যারা উন্নয়ন কাজ করবে তাদের পানি ছিটিয়ে ধুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্ব। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তারা সেটা করছে না। আমাদের পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। আমরা ধুলো দূষণ ও অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধে আরও কঠোর হব।’
একই বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের যুগান্তরকে বলেন, ডিএসসিসি এলাকার অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধে মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস অক্টোবর মাসে সংশ্লিষ্ট সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের কর্মপরিকল্পনা জমা দিতে চিঠি দিয়েছিল।
কিন্তু নির্ধারিত সময় ৩১ অক্টোবরের মধ্যে অনেক সেবা সংস্থা তাদের কর্মপরিকল্পনা জমা দেয়নি। এজন্য ডিএসসিসি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ওই সেবা সংস্থাগুলোকে চলতি অর্থবছরে কোনো উন্নয়ন কাজ করতে দেয়া হবে না।
দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এবার বর্ষা মৌসুমেও অনেক সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে উন্নয়ন কাজের কারণে প্রায় ৩০ ভাগ সড়ক ক্ষতবিক্ষত।
এ অবস্থায় রাজধানী ঢাকায় চলাচল করা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। আর করোনা মহামারীর কারণে বন্ধ থাকা উন্নয়ন কাজগুলো নতুন করে শুরু হয়েছে। এ কারণে রুটিন উন্নয়ন কাজের পরিমাণ বেড়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, মিরপুর ১২ থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সড়কে মেট্রোরেলের উন্নয়ন কাজের কারণে খোঁড়াখুঁড়িযজ্ঞ চলছে।
আর কালশি এলাকায় ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজের জন্য দীর্ঘদিন ধরে মারাত্মক ধুলোবালুর সৃষ্টি হচ্ছে। একদিকে ক্ষতবিক্ষত সড়ক। অন্যদিকে ধুলোবালু সৃষ্ট বায়ুদূষণে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে।
একই চিত্র দেখা গেছে, মিরপুর-১১ নম্বর ভাষানী মোড় থেকে লালমাটিয়া সড়ক, মিরপুর-১২ নম্বর সড়কে ড্রেনেজ সংস্কারের কাজ চলছে, মিরপুর মোহাম্মদীয়া সড়ক, বিহারী পল্লী সড়কটি দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার কাজের জন্য বন্ধ।
উত্তরার ৩, ১০, ১১, ১৩ নম্বর সড়কে ওয়াসার পাইপলাইন বসানোর নামে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এছাড়া বিআরটি’র উন্নয়ন কাজের কারণেও ভোগান্তির সৃষ্টি হচ্ছে।
তুরাগের শাপলার মোড় থেকে ওয়ালটন মোড়, রানাভোলা ৬ নম্বর সড়কে ‘সড়ক, ফুটপাত ও ড্রেনেজ’র উন্নয়ন কাজ চলছে। পুরান ঢাকার বংশাল থেকে বাংলাদেশ মাঠ পর্যন্ত সড়কটি দীর্ঘদিন থেকে খুঁড়ে ফেলে রাখা হয়েছে।
মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনের সড়কেরও বেহাল দশা। দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়ন কাজ বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় ওই এলাকার মানুষের চলাচলের দুর্ভোগের পাশাপাশি মারাত্মক ধুলো দূষণে বিপর্যস্ত হচ্ছে জনজীবন।
খোঁজখবরে জানা যায়, কুড়িল প্রগতি সরণি সড়কও এখন বেহাল। গভীর গর্ত করে উন্নয়ন কাজ চলছে। মাটি, বালু, ইট, সুরকি সড়কের পাশে রাখা হচ্ছে। সেসব বাতাসে ধুলো মিশে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলছে। এসব প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে না।
উন্নয়ন কাজের কারণে মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, শাহবাগ, প্রেস ক্লাব, পল্টন, মতিঝিল এলাকা ধূলিধূসরিত। এসব সড়কে ধুলোর কারণে চলাচল করা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।
ধুলো দূষণে ডিএসসিসির পক্ষ থেকে পানি ছিটানো হলেও সেটা তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। কেননা ৩০-৪০ মিনিট পরে সেটা আগের অবস্থায় চলে আসে।
আরও জানা যায়, মহানগরীর ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরা, বাড্ডা, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় খোঁড়াখুঁড়ি চলছে।
কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, টঙ্গী থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত সড়কে বিআরটি নির্মাণ কাজ চলছে। শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়ায় এখন ধুলো দূষণ মারাত্মকভাবে বেড়েছে।
মাঝেমধ্যে ধুলোর পরিমাণ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে দুই-পাঁচ হাত সামনের গাড়ি পেছন থেকে দেখতে পায় না চালকরা। এতে করে প্রায় অসতর্কভাবে এক গাড়ির সঙ্গে অন্য গাড়ির ধাক্কা লেগে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।
পরিস্থিতি দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে পরিষ্কার থাকলেও পরিস্থিতি উত্তরণে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর তৎপরতা নেই।