খবর৭১ঃ ২০২২ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে নতুন কারিকুলামে শিক্ষা কার্যক্রম চলবে। বদলে যাবে বই, বইয়ের ধরন ও পরীক্ষা পদ্ধতিও। বাদ যাবে অষ্টম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিভাগ ভিত্তিক (বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য) পড়াশোনাও। এছাড়া শিখন কৌশলেও নানা পরিবর্তন আসবে। এ বিষয়ে একটি শিক্ষাক্রম রূপরেখাও তৈরি করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এই রূপরেখা তৈরি করেছে। নতুন এই পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করছেন শিক্ষক-অভিভাবক ও অংশীজনরা। তারা বলছেন, এগুলো খুবই ভালো পদ্ধতি। কিন্তু এর আগে এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ খুঁজে বের করে তা মোকাবিলা করতে হবে।
শিক্ষকরাও বলছেন, এই রূপরেখায় যেভাবে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন হচ্ছে তা আমাদের মতো সমাজে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষের মূল্যায়নে বার্ষিক পরীক্ষার চেয়েও বেশি নম্বর রাখা হয়েছে। আর দশম শ্রেণিতেও ৫০ শতাংশ। কিন্তু শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বড় একটি চ্যালেঞ্জ। আর সব শিক্ষক কতটা নিরপেক্ষভাবে এই মূল্যায়ন করবেন, সেটা নিয়েও নানা প্রশ্ন তৈরি হতে পারে। তাদের বক্তব্য, শুরুতে এই ধরনের মূল্যায়নে কম নম্বর রেখে বিষয়টি পাইলট আকারে দেখা যেতে পারে। বিষয়টিতে সাফল্য পাওয়া গেলে শ্রেণিকক্ষের মূল্যায়নে ধীরে ধীরে নম্বর বাড়ানো যাবে। নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন হবে। এদের কোনো বার্ষিক পরীক্ষা হবে না। ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণিতে ৭০ শতাংশ শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন এবং বার্ষিক পরীক্ষা হবে ৩০ শতাংশ নম্বরের। ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণিতে ৬০ শতাংশ শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন এবং ৪০ শতাংশ বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন হবে। আর একাদশ, দ্বাদশে ৩০ শতাংশ শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন ও ৭০ শতাংশ পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন হবে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, আমরা দেরি করে ফেলেছি, আরো আগে এই প্রক্রিয়ায় যাওয়া উচিত ছিল। শিক্ষানীতির আলোকেই এই নতুন পদ্ধতি হচ্ছে। তবে এতে তিনটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। শিক্ষকদের প্রস্তুত করতে হবে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তুত করতে হবে। ঢাকা শহরের প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকেই তাকালে হবে না। গ্রামের ও চা বাগানের স্কুলগুলোর দিকেও তাকাতে হবে। আর তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হলো বিনিয়োগ লাগবে, আর এই বিনিয়োগে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশের সমস্যা হলো নতুন কোনো পদ্ধতি চালু করতে গেলেই শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে নানামুখী সমালোচনা তৈরি হয়। যা কাম্য নয়।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) প্রাক্তন পরিচালক অধ্যাপক আবুল কাশেম বলেন, বিদেশে এই পদ্ধতি চালু আছে। আমাদেরও শুরু করতে হবে। তবে শুরুর আগে অবশ্যই পাইলট আকারে পরিচালনা করে নিতে হবে। তখন নানা চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। সেগুলো মোকাবিলা করতে হবে। কোনো শিক্ষক নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন না করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রাখতে হবে। প্রয়োজনে বেসরকারি শিক্ষকদেরও আন্তঃস্কুল বদলির ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
কিশলয় উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ বলেন, একেবারে এত বেশি নম্বর শ্রেণিকক্ষ মূল্যায়নে রাখা উচিত হবে না। এটা ধীরে ধীরে বাড়ানো হোক। প্রথমে শ্রেণিকক্ষ মূল্যায়নে কম নম্বর রেখে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে দেখা হোক। সাফল্য পাওয়া গেলে শ্রেণিকক্ষ মূল্যায়নে নম্বর বাড়ানো যেতে পারে। নজরুল আমিন নামে এক অভিভাবক জানান, কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা করা হয়েছিল শিক্ষকের কাছে যাতে শিক্ষার্থীরা জিম্মি না থাকে। প্রাইভেট পড়লে শ্রেণিকক্ষে তার সঙ্গে ভালো আচরণ করা হয়। পরীক্ষায় বেশি নম্বর দেওয়া হয়। পরীক্ষা নেওয়া হলে খাতায় রেকর্ড থাকে। কিন্তু শ্রেণিকক্ষ মূল্যায়ন সব সময় কাগজে কলমে থাকবে না। ফলে এই মূল্যায়ন শিক্ষকের ব্যক্তি চিন্তার ওপর নির্ভর করবে।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি, বিশেষত পাবলিক পরীক্ষা শিক্ষার্থীর মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ মূল্যায়ন করে। তাই প্রচলিত পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতি বহাল রেখে শিক্ষাক্রমের মূল উদ্দেশ্য অর্থাত্ শিক্ষার্থীর জ্ঞানের পাশাপাশি দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং গুণাবলি ও মূল্যবোধ অর্জন সম্ভব হবে না। তাই পাবলিক পরীক্ষায় সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষের মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মূল্যায়নের বিষয়ে রূপরেখায় বলা হয়েছে, মূল্যায়নের উদ্দেশ্য বিবেচনা করে মূল্যায়ন কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। মূল্যায়নে শুধুমাত্র কাগজ-কলমের পরীক্ষার ওপর নির্ভর না করে পর্যবেক্ষণ, পোর্টফোলিও, প্রতিফলনভিত্তিক ও প্রক্রিয়া নির্ভর মূল্যায়ন, ধারাবাহিক মূল্যায়ন, সতীর্থ মূল্যায়ন, অংশীজন মূল্যায়ন ও মূল্যায়ন টেকনোলজির (অ্যাপস) ব্যবহার করা যেতে পারে। শিখনকালীন মূল্যায়ন সম্পূর্ণরূপে অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় পরিচালনা করতে হবে। মূল্যায়নের রেকর্ড যথাযথ উপায়ে সংরক্ষণ করতে হবে। তবে মূল্যায়নের মাধ্যমে অর্জিত শিক্ষাকে শিক্ষার্থীর শিখন নিশ্চিতকরণে অধিক গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। মূল্যায়ন কৌশল এমনভাবে পরিকল্পনা করতে হবে যাতে এর ফলাফল ব্যক্তি-নিরপেক্ষ হয়।
ঢাকা শিক্ষাবোর্ড ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. ফজর আলী বলেন, এটা খুবই ভালো ও গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত তবে বাস্তবায়ন কঠিন হবে। শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে যেভাবে অনিয়ম-দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে, এ কারণে এমন ধরনের প্রশাসন নিয়ে এই কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।